"সালাম সালাম হাজার সালাম" গানের রচয়িতা

Fazl-E-Khuda (1941 – 2021)

স্মৃতির গাড়ি — ঝুম ঝুম …:অরাত্রিকা রোজি

স্মৃতির গাড়ি — ঝুম ঝুম …
অরাত্রিকা রোজি

মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং এর ঠিক পরের সময়গুলোতে রেডিওতে বার

বার শোনা সংগীতের প্রথম দু’লাইনের পরের লাইনগুলোই হয়ে গেলো

“হাসিমুখে যারকাটা
দিয়ে গেলো তারকাটা” ( হাসিমুখে যারা দিয়ে গেলো প্রাণ ) —
আামাদের শিশু মুখের খলবল-সংগীত হয়ে সারাক্ষণ গাইতাম আমরা –
–“সালাম সালাম হাজার সালাম… “

এভাবেই অনন্য একটি সংগীতের সাথে পরিচয়। ৬/৭ বছরের
বালক/বালিকাদের কাছে গীতিকার সুরকার কণ্ঠশিল্পীর কোনো
মূল্যই নেই । গানটিই আসল । বাঁশবনের ভেতর টুকি খেলতে খেলতে,
বিলের ধারের প্রাচীন আম গাছের কালো ছায়ায় কঞ্চি হাতে যুদ্ধ
যুদ্ধ খেলতে গিয়ে…. নানান খেলার ছলে আমাদের ছোটদের খলবল-
সংগীত ছিলো এই গানটি।

তারপর দিন গেছে । মুক্তিযুদ্ধকালীন গীত গানগুলো প্রিয় থেকে
প্রিয়তর হয়েছে আরও ।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তে এসে প্রথম বর্ষেই বাংলাদেশ
বেতারের ‘অনুষ্ঠান ঘোষক”-এর পার্ট-টাইম জব পেলাম । পাঁচ
ঘন্টার ডিউটি — এলেবেলে কাজ নয় — বেশ দায়িত্বশীল কাজ।
রিলিভার এলে তবেই ছুটি মিলতো — ( রিলিভার আসতে পারেন নি বলে
৮৮-র বন্যার এক বিষম-দিনে টানা দশ ঘন্টা ডিউটি করতে হয়েছিল
আমাকে একদম একা )।

আগারগাঁও বেতার কেন্দ্রের কর্মকর্তা ছিলেন ফজল-এ-খোদা ভাই
। খাট্টা মেজাজের মানুষ তিনি । ডিউটি রুমের সংশ্লিষ্ট স্টাফদের
থরহরি কম্প শুরু হয়ে যেতো তিনি এলে । আমাদের এনাউন্সারদের
ডিউটি শেষে বসতে হতো ওই ডিউটি রুম লাগোয়া ওয়েটিং রুমে —
অফিস স্টাফদের প্রতি ভদ্রলোকের ( তখনও তাঁকে আমি চিনতে
পারি নি ) রুক্ষতা আমাকে তাঁর প্রতি বিতৃষ্ণ করে তুলেছিলো ।
একদিন ডিউটি শেষে গাড়ির জন্যে ফোন করতে গিয়ে বকা খেতে হলো
তাঁর কাছে — আমিও ছাড়ার মানুষ নই — ন্যায্য দু’কথা শুনিয়ে
দিলাম — তিনি কিছু বললেন না — হা হয়ে তাকিয়ে রইলেন । এরপর
কিছু জটিলতা তৈরি হলো, আবার মিটেও গেলো ।

এর বেশ কিছু বছর পর মানে মাস্টার্স করছি তখন — বিয়েও করে
ফেলেছি । তখন রেডিও টিভি দু’জায়গায় উপস্থাপনা করি । একটি
রেকর্ডেড প্রোগ্রামের জন্যে কিছু অংশ পাঠ করে দিতে হবে —

গেলাম সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার রুমে স্ক্রিপ্ট বুঝে নেয়ার জন্য —
ওমা, দেখি — আমার অপছন্দের মানুষটি বসে আছেন কর্মকর্তার
চেয়ারে, মেজাজ শান্ত রেখে কাজ বুঝে নিয়ে চলে আসবো, তিনি কি
ভেবে আমাকে বসালেন — রাজনীতির নানান প্রসঙ্গ নিয়ে কথা
বললেন । কথা যখন খুব জমে উঠেছে — যে ভাইটি আমাকে নিয়ে
গেছিলেন, তিনি গল্পের এক ফাঁকে জানালেন — “সালাম সালাম
হাজার সালাম ” গানের রচয়িতা আপনার সামনে বসে ( সেই সময়
‘জনকণ্ঠে’ মুক্তিযুদ্ধের উপর আমার কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছিলো
) । এই কথা শুনে আমি বেশ কিছুটা সময় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ।
আমার শরীর থরথর করে কাঁপছিলো । আমার দিকে তিনি একগ্লাস
পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন — ‘বোকা মেয়ে, নাও পানি খাও ।’ আমি
পানি খেয়ে সারার পর বললেন — ‘ এতো আবেগী তুমি, কপালে অনেক
দুঃখ আছে ।’ আমি শুধু বলতে থাকলাম — “আমার বিশ্বাস হচ্ছে না !
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না !” — এরপর ফজল-এ-খোদা ভাইয়ের
প্রযোজনায় অনেক অনুষ্ঠানে কণ্ঠ দিয়েছি — রেডিও বাংলাদেশের
ইনহাউজ একটি সাময়িকীতে বেশ ক’টি লেখা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে
নিয়েছেন ।

পরবর্তীতে এমন হলো — তাঁর ভেতর যে কেজো লোকের বাস — সেই
কেজো মানুষের রুক্ষতাকে আর অযৌক্তিক বলে মনে হলো না
কোনোদিন ।

কাজের কথা বলতে গিয়ে ফজল-এ-খোদা ভাইয়ের সাথে নানান বিষয়ে
দীর্ঘ আড্ডা হতো তখন । তাঁর কাছ থেকেই জেনেছিলাম ‘কালোমেঘ”
আগাছার ঔষধিগুণ । আমার কাগজী লেবুর টবে কালোমেঘ জন্মে
আছে — প্রায় সময় জন্মায় । ওকে দেখলেই ফজল-এ-খোদা ভাইয়ের
কথা মনে পড়ে । তাঁর সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে প্রসঙ্গ থেকে
প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া — কখনও মনে হয়নি তখন — তিনি রুক্ষ,
খাট্টামেজাজি-মানুষ — অদ্ভুত এক পরিমিতবোধে নিমগ্ন এক
পরিচ্ছন্ন-মানুষ — নিজের কাজ ও নিজের বোধের গভীরে নৌকা
বাওয়া এক সৃষ্টিশীল মানুষ তিনি ।

সৃষ্টিশীল মানুষের আসা আছে, যাওয়া নেই ।
শোকও করি না তাই ।
লেখক পরিচিতি: লেখক এবং পেশাগতভাবে একজন অ্যাডভোকেট

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *