৪ জুলাই ২০২২ কবি ফজল-এ-খোদার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীকে সামনে রেখে ১ জুলাই ২০২২ দৈনিক ইত্তেফাকের সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় প্রখ্যাত গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের স্মৃতিচারণমূলক এই লেখা–
বাংলাদেশপ্রেমিক একজন কবি
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
আমরা বন্ধুবান্ধবেরা তাঁকে ডাকতাম ‘ফজলে’ বলে। আসলে তাঁর নাম ফজল-এ-খোদা। কবে থেকে তিনি আমার এত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, তা আর এখন মনে করতে পারি না। একটা সময় আমরা প্রচুর আড্ডা দিতাম। তখন ধানমন্ডির দুই নম্বরের কোনায় ডিজি অফিসটা ছিল। ওখানে আমি প্রোগ্রাম প্লানিংয়ের লোক হয়ে বসতাম। শহীদুল ইসলাম বসতেন। ওখানেই ফজল-এ-খোদার বেতার বাংলার অফিস ছিল। আর আশরাফুল আলমও ওখানে বসতেন। আমরা এই চারজন প্রচুর আড্ডা দিতাম।
ফজল-এ-খোদার সঙ্গে এই যে ঘনিষ্ঠতার কথা বললাম, এই ঘনিষ্ঠতার অনেক আগেই কিন্তু ফজল-এ-খোদা আমার কাছে একটি পরিচিত নাম। আমার প্রথম গান ১৯৬৫ সালে বেতারে ‘এ-মাসের গান’ (চার সপ্তাহে একই গান চার শিল্পী এককভাবে গাইতেন) হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল। যেহেতু আমি ঢাকায় থাকতাম না, সেই কারণে আমার গান খুব কমই প্রচারিত হতো। তখন যাঁদের গান খুব বেশি প্রচারিত হতো, যাঁদেরকে আমরা শুনতাম মনোযোগ দিয়ে—কবি আজিজুর রহমান তো ছিলেনই; এছাড়া ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মাসুদ করিম, ফজল-এ-খোদা—এঁদের গান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। আমি ঢাকায় এলাম ১৯৭৩ সালে। ঢাকায় আসবার আগ পর্যন্ত এই বিশিষ্ট কয়েকজনের নামই আমি জানতাম। ও হ্যাঁ, আরেকজন ছিলেন জেব-উন-নেসা জামাল—তাঁর গানও প্রচুর প্রচারিত হতো।
ফজল-এ-খোদা বিভিন্ন ধরনের গান লিখেছেন। আমাদের যখন সংগ্রাম চলছে, তখনও স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়নি। মিছিল চলছে, মিটিং চলছে সর্বত্র রাস্তায় রাস্তায়। শহিদ হচ্ছে পুলিশের গুলিতে, আর্মির গুলিতে আমাদের মতো মানুষ। সাধারণ মানুষেরা। তো এই অনুভূতিটিকে নিয়েই বঙ্গবন্ধুর একটা প্রচ্ছন্ন নির্দেশে ফজল-এ-খোদার যে গানটি ঢাকা রেডিওতে রেকর্ড হয়েছিল—সেই গানটি চিরকালীন হয়ে গেছে। বাংলা গানে, বাংলাদেশের বাংলাগানে যদি নাম করতে হয়, তাহলে চিরকালের গানের মধ্যে সেই গান একটি—‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহিদ স্মরণে’। এ-গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত বেজেছে। তার আগ পর্যন্ত ঢাকা রেডিও থেকে নিয়মিতই প্রচারিত হয়েছে। এই গানটির জন্য আমাদের কাছে যখন পরিচিত মুখ হয়ে গেলেন ফজল-এ-খোদা। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এটুকু শুনলেই ওঁর চেহারাটা ভেসে উঠত।
কত গান, ফজল-এ-খোদার কত গান—আমি যদি নাম বলতে চাই। যে গান শ্রোতারা শুনেছেন। বারবার শুনেছেন, মুগ্ধ হয়ে শুনেছেন। যেমন ‘কলসি কাঁখে ঘাটে যায় কোন রূপসী’, ‘বাসন্তী রং শাড়ি পরে কোন্ বঁধুয়া চলে যায়’, ‘আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে’, ‘মন রেখেছি আমি তার মনেরও আঙিনায়’, ‘ভালোবাসার মূল্য কত’—এসব গান শোনেননি, বাংলাদেশে বোধহয় এমন কেউ নেই।
ফজল-এ-খোদার সঙ্গে মাঝ যৌবনে মানে যৌবনেরও মধ্যকালে আমার পরিচয় এবং হৃদ্যতা। যখন শাহবাগ থেকে বেতার চলে আসে আগারগাঁওয়ে, তখন মাঝেমধ্যে যেতাম। এবং গেলেই খোঁজ করতাম আর খোঁজ করলে আমার কী সৌভাগ্য পেয়েও যেতাম। তারপর দুজন মিলে অনেক বিষয়ে আড্ডা দিতাম। আমার দুটি বই আছে—‘আধুনিক বাংলাগান রচনার কলাকৌশল’ এবং ‘বাংলা গান রচনাকৌশল ও শুদ্ধতা’। পরে প্রথম বইটি বাদ দিয়ে দ্বিতীয় বইটিকে নেওয়া হয়েছে। ফজল-এ-খোদা নিজের টাকায় এই বইয়ের কয়েক শ কপি কিনেছেন। এবং যে-ই তাঁর কাছে গান লেখার তালিম নিতে আসত—তাকেই তিনি বইটা ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘এটা পড়ো তারপর আমার কাছে এসো। আগে এটা পড়ে নাও।’ তিনি আমাকে বলতেন, ‘এটা যেমন আপনার লেখা, লেখাটা আপনার কর্তব্য; এর প্রচার-প্রসারটা আমাদের কর্তব্য।’ ক’জন এমন করে ভাবেন? এই তো বন্ধু।
ফজল-এ-খোদার বিষয়ভিত্তিক প্রচুর গান আছে। যে কোনো বিষয় তাঁর হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত করলেই তাঁর কলম সজাগ হয়ে উঠত। এবং তিনি লিখতেন। এবং সেই লেখা মানে মোদ্দা কথাটি এমন মোক্ষমভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলতেন যে পরে কী আছে তা না-ভাবলেও চলত। কারণ ওখানেই মানুষের ভাবনাচিন্তা আটকে থাকে। মুখরা যেটাকে বলে গানের আস্থায়ী—তার মধ্যেই। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহিদ স্মরণে/আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই তাদের স্মৃতির চরণে’—এর পরে আর কী আছে তা কি ভাবার প্রয়োজন হয়?
ফজল-এ-খোদা বাংলাদেশপ্রেমিক একজন কবি। তাঁর ‘কাজল মাটির গান’ নামে একটি বই আছে, যেখানে আমাদের গ্রামের বিচিত্র চিত্র আছে গানগুলির মধ্যে। অপূর্ব সুন্দর তাঁর যে নির্বাচিত গানের বইটি, সেটি প্রকাশিত হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমি থেকে। বড় দুঃখ—বাংলা একাডেমি তাঁকে চিনল না। বাংলা একাডেমি কেন জানি না গানের কবিতাকে কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। যে বাংলা কবিতা বাংলাভাষা—এর জন্মই হয়েছে গানের মধ্যে দিয়ে। আমরা সর্বপ্রাচীন যা এ পর্যন্ত পেয়েছি—চর্যাপদ, সেই চর্যাপদের সমস্ত কবিতার ওপরে রাগের নাম তালের নাম লেখা আছে। অর্থাৎ সেটি গান। যে ভাষা জেগে উঠেছে গানের মধ্যে দিয়ে, সেই ভাষার গানের কবিতাকে কবিতা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না—এটা আমার কাছে সাহিত্যভক্ত মানুষের কাজ বলে মনে হয় না। আমি দুঃখিত—কথাটি আমাকে বলে ফেলতে হলো। কিন্তু ফজল-এ-খোদা বাংলা গানে জীবিত থাকবেন।
একুশের একটি অনুষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে প্রতিবছর প্রচার হতো। অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনায় আমি ছিলাম। ফজল-এ-খোদার ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’—একুশের শহিদ থেকে আরম্ভ করে মুক্তিযুদ্ধের শহিদ সবাই যে এই গানটির মধ্যে আছেন, সে-কথা আমার মনে হয়েছে। আমি সেই বর্ণনাসহ গানটিকে যুক্ত করে অনুষ্ঠানটিকে মর্যাদাবান করি। অনুষ্ঠানটি প্রতিবছর বাজত। ফজল-এ-খোদা একদিন আমাকে বলেছিলেন—আপনি তো এ গানটাকে একেবারে প্রতিবছরের জন্য নিশ্চিত করে দিলেন। আমি বলেছিলাম, আমি করিনি—এ গান তার নিজের গুণে ওখানে জায়গা করে নিয়েছে। আমি না-যদি এই গানটি ওর মধ্যে প্রবেশ করাতাম, তাহলে আমি অপরাধ করতাম।
আজকে ফজল-এ-খোদা নেই, সে-কথা আমি ভাবতে চাই না। ভাবব না। যতদিন বেঁচে আছি, ভাবব এবং মনে করব আমরা আছি। ওরকমই আছি—ছন্নছাড়া, যে যার মতো পাগলের মতো লিখি। হাত থেকে লেখা নিয়ে যায় মানুষ, আমাদের কাছে কোনো কপিও থাকে না। পরে সেইসব শিল্পীর কাছ থেকে, সেইসব গানের সুরস্রষ্টারা—তাঁদের কাছ থেকে গান সংগ্রহ করে বই বের করতে হয়। আমরা সেই পাগলই আছি! এই পাগল নিয়ে একটা গান ছিল ফজল-এ-খোদার—‘পাগল ছাড়া মানুষ বুঝি নাই রে দুনিয়ায়!’ মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের গাওয়া। গানটা শুনে গায়ক এবং গানের কবিকে দেখতে রেডিও অফিসে চলে এসেছেন একজন বৃদ্ধ বয়স্ক মানুষ, একটু বাউল ধরনের। জব্বার তাঁকে গানটা শোনালে তিনি বললেন, ‘তুমি বাবা এটা গাইতে পার ঠিক আছে। কিন্তু এই ছোকরা (ফজল-এ-খোদাকে দেখে) লিখেছে আমি বিশ্বাস করি না।’ আসলে মানুষের মধ্যে যে পরিপক্বতা কোন বয়স থেকে কখন থেকে ঢোকে এবং তা উঁকি দিতে শুরু করে যৌবনে এসেই—ফজল-এ-খোদার ঐ গান তার প্রমাণ।
লেখক পরিচিতি: গীতিকার, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
উল্লিখিত লেখাটির লিঙ্ক-
https://www.ittefaq.com.bd/604207/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9C%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF