"সালাম সালাম হাজার সালাম" গানের রচয়িতা

Fazl-E-Khuda (1941 – 2021)

জনপ্রিয় গানের গীতিকার ফজল-এ-খোদা: মোহাম্মদ মাসুদ খান

৯ মার্চ ২০২১-এ কবি ফজল-এ-খোদার ৮০তম জন্মদিনকে সামনে রেখে
দৈনিক যায়যায়দিনে শাপলা শালুকের আসরের অন্যতম সংগঠক, লেখক-
ছড়াকার মোহাম্মদ মাসুদ খানের নিচের লেখাটি প্রকাশিত হয়।

মোহাম্মদ মাসুদ খান
দৈনিক যায়যায়দিন, ১৯ মার্চ ২০২১

এ দেশের জনপ্রিয় গানের গীতিকার ফজল-এ-খোদা। গত ৯ মার্চ-২০২১ ছিল
প্রখ্যাত গীতিকার, কবি, বেতার ব্যক্তিত্বও শিশুসংগঠক ফজল-এ-খোদার
৮০তম জন্মবার্ষিকী। বাবা মুহাম্মদ খোদা বক্স এবং মা মোসাম্মাৎ
জয়নবুন্নেছার ঘরে জন্ম নেওয়া প্রথম সন্তান ফজল-এ-খোদার জন্ম
১৯৪১ সালের ৯ মার্চ, পাবনার বেড়াথানারবন গ্রামে। বাংলাদেশ বেতারের
পরিচালক হিসাবে ১৯৯৮ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।
ফজল-এ-খোদা শিশু-কিশোর সংগঠন শাপলা শালুকের আসরের প্রতিষ্ঠাতা
পরিচালক। ‘মিতা ভাই’ নামে তিনি শাপলা শালুকের আসরের সদস্যদের কাছে
সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। মূলত ১৯৭৩ সালে বেতারভিত্তিক শিশুসংগঠন
হিসাবে শাপলা শালুকের আসর যাত্রা শুরু করে। পচাত্তরের পটপরিবর্তনের
পর শাপলা শালুকের আসরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৮/৭৯ সালে
পুনরায় তিনি নিজ উদ্যোগে শাপলা শালুকের আসরের কার্যক্রম চালু করেন।
তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সারাদেশে সংগঠনটির তিন শতাধিক শাখা গড়ে ওঠে।
১৯৫৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক অধ্যয়নকালে তিনি তার শৈশব বন্ধু গায়ক
মদনমোহন দাসসহ পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।
বিমান বাহিনীর রিক্রুটিং স্কুলে প্রায় সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো।
একদিন গ্রাউন্ড প্রশিক্ষক কর্পোরাল জহুরুল হক (পরবর্তীতে সার্জেন্ট
যিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত) ফজল-এ-খোদাকে

বললেন ‘তুই নাকি লিখতে-টিকতে পারিস? দেশের ওপর একটা গান ল্যাখ না।
মদন সুর করে দেবে। ওরা পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি, পশতু গান গায়, তোরা
একটা বাংলা গান গাইতে পারবি না?’ মূলত এই কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি
লিখে ফেলেন একটি দেশের গান। গীতিকার হিসেবে শুরু হয় তার যাত্রা। ১৯৬১
সালে ভিলেজ এইডে চাকরি নিয়ে ঢাকায় আসলে পরিচয় ঘটে কণ্ঠশিল্পী
মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সঙ্গে। জব্বার তখন উদীয়মান একজন
জনপ্রিয় শিল্পী। ফজল-এ-খোদার ডাইরি ঘেঁটে ‘আমি প্রদীপের মতো রাত
জেগে জেগে’ গানটি দেখে আবদুল জব্বার খুবই পছন্দ করেন এবং সুর করে
কণ্ঠ দান করেন। আবদুল জব্বার ওই ডাইরি থেকে আরও একটি লেখা ‘আমি
যদি সাগর হই তুমি ঢেউ হবে’ গানটি সুর করেন। ১৯৬৩ সালে ফজল-এ-খোদা
তৎকালীন পাকিস্তানে বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হিসেবে নিবন্ধিত
হন। ১৯৬৪ সালে তিনি টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত হন। তার লেখা বহু গান
বাংলার মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছে।
‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি মুক্তিযুদ্ধে সাত কোটি মানুষকে
উদ্দীপ্ত করেছে। ১৯৭১-এ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তার লেখা গান
সংগীত ‘সংগ্রাম, সংগ্রাম, সংগ্রাম চলবে, দিনরাত অবিরাম’ গানটি
তৎকালীন টেলভিশিন প্রচার করে যার ধরন সম্পর্কে শহীদ জননী
জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি বইতে উলেস্নখ করেছেন। ফজল-
এ-খোদা’র কালজয়ী অনেক গান এখনো মানুষকে আন্দোলিত করে। ‘যে
দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’, ‘ভালোবাসার মূল্য কত আমি কিছু
জানি না’, ‘কলসি কাঁধে ঘাটে যায় কোন রূপসী’, বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে কোন
বধূয়া চলে যায়’, ‘আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে’, ‘প্রেমের এক নাম
জীবন’, ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো, পথের ধুলোয় লুটোবে’, ‘আমি বন্ধু
প্রেমে হইলাম পাগল’, ‘ঢাকা শহর ঘুরতে এসে ঘুরছি গোলক ধাঁধায়’ ইত্যাদি
অজস্র গানের রচয়িতা ফজল-এ-খোদার গানগুলোর অধিকাংশই প্রয়াত বশীর
আহমেদ, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী,
রথীন্দ্রনাথ রায়ের মতো কিংবদন্তী শিল্পীদের কণ্ঠে দর্শক-শ্রোতাদের
কাছে পৌঁছেছে। আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, ধীর আলী, সুবল দাস, কমল

দাশগুপ্ত, আবেদ হোসেন খান, অজিত রায়, দেবু ভট্টার্চায, সত্য সাহা
প্রমুখের মতো সংগীতজ্ঞ ফজল-এ-খোদার গানগুলোতে সুরারোপ করছেন।
গানের উপর ফজল-এ-খোদার অনেক সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামী
গানের দুটি সংকলন ইসলামী গান (১৯৮০) ও বন্দেগী (২০০২), ছোটদের
উপযোগী ফুল পাখিদের গান (১৯৮৬), দেশপ্রেমের গান নিয়ে মন্দিরা
(১৯৯৭), নির্বাচিত গানের সংকলন (১৯৯৭)। পলস্নীগীতি, ভাটিয়ালী,
ভাওয়াইয়া, কীর্তন, শ্যামা, ভজন ইত্যাদি লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারার
গানের সংগ্রহ কাজল মাটির গান (২০১২), সংগীত ভাবনা (২০১২)। কবিতা,
প্রবন্ধ, নাটকও লিখেছেন ফজল-এ-খোদা। ১৯৬৮ সালে বেরিয়েছে তার
কবিতার বই ‘সূর্য স্বর্ণ দ্বীপ’, ১৯৭৩ সালে ‘বিতর্কিত জ্যোৎস্না’,
১৯৯০ সালে ‘নামে যার কেঁপে ওঠে’, ২০০৮ সালে ‘তাড়া করে অশুভ সময়’ এবং
২০১৪ সালে ‘নির্জন পঙ্‌ক্তিমালা’। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি ১৯৭৭ সালে
লিখেছেন ‘মিতা ভাইয়ের আসর’, ১৯৯০ সালে ‘আড়ি’, ২০০০ সালে ‘নাটক
নাটক’, ২০০১ সালে ‘জয় মুক্তিযুদ্ধ’ ২০০৭ সালে ‘রবীন্দ্র নজরুল বঙ্গবন্ধু
জয়নুল’, ২০১১ সালে ‘রয়েল বেঙ্গল’, ২০১২ সালে ‘আড়ং’ ইত্যাদি। এ ছাড়া
সত্তর দশকে শিশু-কিশোরদের মাসিক পত্রিকা ‘শাপলা শালুক’ ফজল-এ-
খোদার নিপুণ সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো। ফজল-এ-খোদার বইগুলো প্রকাশ
করেছে বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা
একাডেমি, মুক্তধারা, আগামী এবং অবসরের মতো স্বনামধন্য
প্রতিষ্ঠানগুলো। ফজল-এ-খোদার সর্বমোট বইয়ের সংখ্যা ৩৩টি। তার লেখা
কবিতা ও গানে বাংলাদেশের চিরাচরিত লোকজ জীবনধারা, মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা ও দেশপ্রেম ফুটে ওঠে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হলে ফজল-এ-খোদা
তার দুঃখ এবং ক্ষোভ গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন যা সেই সময়ে
কল্পনাতীত ঘটনা। বশীর আহমদের সুরারোপে মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের
গাওয়া ফজল-এ-খোদার সেই গানটি ছিল ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো/
পথের ধুলোয় লুটোবে / সাত রঙে রাঙা স্বপ্ন-বিহঙ্গ / সহসা পাখনা লুটোবে/
এমন তো কথা ছিল না’। গানটি ১৯৭৬ সালে রেকর্ড ও বেতারে প্রচারিত হয়।

ফজল-এ-খোদার লেখা এবং মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সুরারোপ করা
‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি ২০০৬ সালে বিবিসির সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের সেরা ২০টি গানের তালিকায় ১২তম (দ্বাদশ) স্থান
পায়। ১৯৬০ দশক থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরের অধিক
সময় ধরে ফজল-এ-খোদা অসংখ্য দেশাত্মবোধক, আধুনিক, লোকসংগীত,
ইসলামী গানসহ আরও অনেক গান লিখেছেন। ৮০ উত্তীর্ণ গুণী এই মানুষটি
আজ ডায়াবেটিক এবং কিডনি রোগ ছাড়াও জটিল ডিমেন্সিয়া রোগে
আক্রান্ত। ভুলে গেছেন তার বহু অতীত স্মৃতি। মোহাম্মদপুর বাবর রোডের
বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন ফজল-এ-খোদা। টেলিভিশন এবং সংবাদ
মাধ্যমগুলোর অনেকেই তার বর্তমান অবস্থার খবর জানেন না। সংশ্লিষ্ট
মন্ত্রণালয় বিষয়টির প্রতি যথাযথ দৃষ্টি দেবেন যাতে তিনি সুচিকিৎসা পান
এবং নতুন প্রজন্ম তার সৃষ্টিকে জানতে পারেন। ফজল-এ-খোদার পৈতৃক
বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানার রতনকান্দি গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায়।
বাবা মায়ের চার ছেলে এক মেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। ডাকনাম মজিদ।
প্রাতিষ্ঠানিক লেখা পড়া চূড়ান্ত করতে পারেননি। স্ত্রী মাহমুদা সুলতানা,
গল্পকার। তিন পুত্রের দুই পুত্র সাংবাদিক, এক পুত্র ব্যাংকার। নাতি-
নাতনির সংখ্যা ৬। গত ৭ মার্চ ঘোষণা করা হয়েছে ২০২১ সালের স্বাধীনতা
পদকপ্রাপ্তদের নাম, যারা পদক পেয়েছেন তাদের অধিকাংশ জীবিত নেই।
পেয়েছেন মরণোত্তর পদক যা তারা বেঁচে থাকাকালে পাননি। যদিও অতি
সম্প্রতি ফজল-এ-খোদার রচিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তথাপি দুঃখজনক হলেও
সত্যি যে সর্বকালের সেরা ২০টি গানের তালিকায় স্থান পাওয়া ‘সালাম
সালাম হাজার সালাম’ গানের গীতিকার ফজল-এ-খোদা আজও কোনো পদক
পাননি। হয়তো পাবেন মরণোত্তর কোনো স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক
কিংবা বাংলা একাডেমি পুরস্কার যা বেঁচে থাকা অবস্থায় কাঙ্ক্ষিত নয়।
ফজল-এ-খোদা আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন এই
আমাদের প্রত্যাশা। ৮০তম জন্মদিনে তার প্রতি রইল লাখো লাখো সালাম ও
শ্রদ্ধা।

লেখক পরিচিতি: লেখক, ছড়াকার, সংগঠক

লেখাটির লিঙ্ক:
https://www.jaijaidinbd.com/feature/literature/153550

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *