"সালাম সালাম হাজার সালাম" গানের রচয়িতা

Fazl-E-Khuda (1941 – 2021)

স্মরণে কবি ফজল-এ-খোদা: মাহমুদউল্লাহ

স্মরণে কবি ফজল-এ-খোদা

মাহমুদউল্লাহ

আমার জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা ছিল অভাবনীয়। এমন একটি ঘটনাই আমার চঞ্চল-অস্থির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। না, এই ঘটনা আমাকে সমাজের ওপরের স্তরে উঠিয়ে দিয়েছে, তা নয়। তবে আমার নিজের জন্য উপযুক্ত একটি অবস্থানে আমাকে পৌঁছে দিয়েছে। একটি দৈনিক পত্রিকায় আমি সাব-এডিটর পদে কাজ করতাম। সরকারের নেওয়া ব্যবস্থার কারণে আমাদের পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয় বেশ কিছুদিনের বেতন পরিশোধ না করেই। অনেক চেষ্টা করেও সে টাকা পাওয়া যায়নি। বেকারজীবনে কাজের খোঁজে ঘুরছি তখন। সেই দিনটি আমার বেশ মনে পড়ে। শাহবাগ থেকে হেঁটে যাচ্ছি রমনা পার্ক বাঁয়ে রেখে। সহসা পুব দিক থেকে এগিয়ে আসা একটা রিকশা থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো আমার কানে—মাহমুদ ভাই, আপনার কাজবাজ কিছু একটা হলো? কণ্ঠস্বরটি ছড়াকার মুস্তাফা মজিদের। বললাম, না-না, কোথাও কিছু হয়নি। তরুণ বন্ধুটি বললেন, তাহলে উঠুন আমার রিকশায়। আমি ফজল-এ-খোদা ভাইয়ের অফিসে যাচ্ছি। উঠে পড়লাম রিকশায়। সায়েন্স ল্যাবরেটরি ডানে রেখে মিরপুর রোডে উঠে এসে গেলাম ধানমন্ডি ২ নম্বরে বাংলাদেশ বেতারের দফতরে। আমরা সাক্ষাৎ করলাম ফজল-এ-খোদা ভাইয়ের সঙ্গে।

সাহিত্য-সংগীতসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিভার অধিকারী মানুষটি সম্পর্কে জানতাম। এই প্রথম তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। আমার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলেন মুস্তাফা মজিদ। জানালেন, এ মুহূর্তে একটা কাজ না হলে আমার পক্ষে ঢাকা থাকা সম্ভব নয়। ফজল-এ-খোদা ভাই আমার বিষয়টি অনুধাবন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন কিছু একটা করার। তিনি বাংলাদেশ বেতারের বার্তা পরিচালক আনিস চৌধুরীর কাছে চিঠি লিখে বাংলা সংবাদ বিভাগে আমার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ জানালেন। লেখক-সাহিত্যিক বলে আমার পরিচয় দিলেন তিনি। আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের জন্য এটা ছিল একটা মর্যাদার বিষয়।

আমি সেই চিঠি নিয়ে চলে যাই শাহবাগে বাংলাদেশ বেতারের কার্যালয়ে। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করি বার্তা পরিচালক আনিস চৌধুরীর কক্ষে। সুসাহিত্যিক বিশেষ করে প্রখ্যাত নাট্যকার আনিস চৌধুরীকে দেখতে পাই আমারই চোখের সামনে। যাঁর নাটক ‘মানচিত্র’ মঞ্চস্থ করার ব্যবস্থা করি আমি কুর্মিটোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সময়। হ্যাঁ, যা বলছিলাম—আমি তাঁর হাতে তুলে দিলাম সেই চিঠি। তিনি চিঠি পড়ে কর্মকর্তা তাসিকুল আলম খানের সঙ্গে আমার বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো বাংলা সংবাদ বিভাগে। বাংলা সংবাদ অনুবাদে আমার হাত কী রকম তা পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় নূরুল ইসলাম সরকারকে। তিনি বার্তা বিভাগে অন্যতম সম্পাদক-তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একটি ইংরেজি পাতা তুলে দেন আমার হাতে। আমার অনুবাদ কিছুটা শেষ হতেই তিনি তা পড়ে দেখলেন। বললেন, আর দরকার নেই—ঠিক আছে। আমাকে জানানো হলো, আগামী মাসে আমি কাজে যোগদান করতে পারব। সপ্তাহে তিন দিন কাজ করার ব্যবস্থা রেখে আমার নাম শিডিউলে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। কাজে যোগ দিলাম ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে।

এবারে কবি ও সম্পাদক ফজল-এ-খোদার সঙ্গে শুরু হলো আমার নিয়মিত যোগাযোগ। তিনি আমার কাছে লেখা চাইলেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘বেতার বাংলা’য় ছাপা হয় আমার ‘পর’ ও ‘স্বার্থ’সহ কয়েকটি গল্প। আমার ‘পাণ্ডুলিপির নেপথ্যে’ নামে একটি নাটকও প্রকাশিত হয় এই পত্রিকায়। তাঁর উদ্যোগে নাটকটি প্রচারিত হয় বাংলাদেশ বেতারে। এছাড়াও আমার ‘রবির ছেলেবেলা’ নাটকটিও প্রচারিত হয় তাঁর উদ্যোগেই।

১৯৭৪ সালের আগস্ট মাস থেকে ফজল-এ-খোদার সম্পাদনায় বেতার প্রকাশনা দফতর থেকে ছোটোদের মাসিক পত্রিকা ‘শাপলা শালুক’ প্রকাশ হতে শুরু করে। এই পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় ছাপা হয় আমার হাসির কবিতা ‘আজব কাণ্ড’।

স.ম. শামসুল আলমের আনন ফাউন্ডেশন কবি ফজল-এ-খোদার জন্মোৎসব পালন করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বেতারে আমার কর্মজীবনে তাঁর অবদানের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, এটা নিয়ে বলার কী আছে। রেডিওতে অমন চুক্তিভিত্তিক কাজ মানুষ কত নেয় আবার ছেড়ে চলে যায়।

ফজল-এ-খোদা ভাই যা বলেছেন তা সত্য বলেছেন। আমিও জীবনে কিছু চাকরি বা কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি। আয়কর বিভাগে ইউডিসির পদে কাজ করতে ভালো লাগল না, ছেড়ে দিলাম। বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ কয়েকটি কর্মস্থল ছেড়েছি নানা কারণে। কিন্তু বাংলাদেশ বেতারে আমার বিষয়টি ছিল ভিন্ন রকমের। আমার তিন দিনের চুক্তিভিত্তিক কাজ ছ দিনের হয়ে যায়। আমি একদিন স্টাফ আর্টিস্ট বা নিজস্ব শিল্পী হয়ে যাই। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম আবার সরকারি চাকরি পেলাম। বেতারে আমার চাকরি প্রসঙ্গটি নিয়ে যখনই ভাবি তখনই আমার চোখে ভেসে ওঠে প্রিয় ফজল-এ-খোদা ভাইয়ের মুখটি।

ফজল-এ-খোদা সারা দেশে পরিচিত তাঁর রচিত সংগীতের জন্য। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান গীতিকার। জাতীয় জীবনের বিশেষ দিন বা ভাষা প্রসঙ্গে তাঁর গান রেডিও-টেলিভিশনে শুনেছি। তাঁকে দেখার আগে গানের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় পেয়েছি। বিশেষ করে একটি গান তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেছে। শহরে-নগরে, গ্রামে-গঞ্জে এই গানের জন্য তিনি ঈর্ষণীয় খ্যাতি অর্জন করেন। গানটি হলো—

সালাম সালাম হাজার সালাম

সকল শহিদ স্মরণে

আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই

তাদের স্মৃতির চরণে।

গানটি শুধু রেডিও-টেলিভিশনে, অনুষ্ঠানে নয়—হাটে-মাঠে-ঘাটে মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। মনে পড়ে একদিনের কথা। হেঁটে যাচ্ছিলাম গ্রামের পথে। ছোট্টো নদীর খেয়া পার হলাম। নদী বেষ্টিত গ্রাম চর ডিক্রিতে পা ফেলতেই শুনলাম মাঠে জমি চাষ করতে করতে গান গাইছে এক রাখাল, সালাম সালাম হাজার সালাম। দুষ্টু রাখালটি এই গানের প্যারোডিও গাইল। একটা গান কতটা জনপ্রিয় হলে তা উঠে আসতে পারে একটি শান্ত-দ্বীপ গ্রামের এক রাখালের মুখে—তাই ভাবছিলাম পথ চলতে চলতে।

ফজল-এ-খোদার দুটি গান ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর ‘ভাষা ও দেশের গান’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। তাঁর প্রথম গানটি হলো—সালাম সালাম হাজার সালাম। অপর গানটির অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরছি—

যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে,

যে দেশেতে কলমি কমল কনক হয়ে হাসে

সে আমাদের জন্মভূমি মাতৃভূমি বাংলাদেশ।

বইটিতে প্রতিটি গানের স্বরলিপি রয়েছে। এই গ্রন্থে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, মুকুন্দ দাস, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদদীন, আজিজুর রহমান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে ফজল-এ-খোদা নামটি জ্বলজ্বল করছে। তাঁর ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটির সুরকার মোহাম্মদ আবদুল জব্বার এবং ‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’ গানটির সুরকার আবেদ হোসেন খান। দুটো গানের স্বরলিপিকারই ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী। এছাড়াও প্রচুর গানের রচয়িতা ফজল-এ-খোদা। স্বল্প পরিসরে তাঁর গান সম্পর্কে বলা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে আমার সামর্থ্যও সীমিত।

ফজল-এ-খোদা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক গুণীজন। আধুনিক কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি শিশুসাহিত্যের সকল শাখায় অবদান রেখেছেন। তাঁর ‘মুক্তিবাহিনী’ ছড়াটি উদ্ধৃত করছি—

ঘটনা ঘটছে ঘটুক না

রটনা রটছে রটুক না

শাসক চটছে চটুক না

হচ্ছে কাহিনি

মুক্তিবাহিনী।

কৃষক জাগছে জাগুক না

শ্রমিক লাগছে লাগুক না

দালাল ভাগছে ভাগুক না

হচ্ছে কাহিনি

মুক্তিবাহিনী।

শত্রু আসছে আসুক না

রক্তে ভাসছে ভাসুক না

মৃত্যু হাসছে হাসুক না

হচ্ছে কাহিনি;

মুক্তিবাহিনী।

গাঁয়ের মায়াবী সুন্দর ছবি এঁকেছেন তিনি তাঁর ‘গাঁ’ নামক ছড়ায়—

ঐ আমাদের গাঁ—

তারি পাশে নদী

বহে নিরবধি

ঘাটে বাঁধা না’

ঐ আমাদের গাঁ।

ঐ আমাদের গাঁ

পথটি আঁকাবাঁকা

দূর্বাঘাসে ঢাকা

শিশির ভেজায় পা,

ঐ আমাদের গাঁ।

ফজল-এ-খোদা একজন আধুনিক কবি, গীতিকার হিসেবেই নন, একজন ছড়াকার ও নাট্যকার হিসেবেও সার্থক। তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা অনেক। কবিতা—সূর্য স্বর্ণ দ্বীপ, বিতর্কিত জ্যোৎস্না, নামে যার কেঁপে ওঠে, তাড়া করে অশুভ সময়, নির্জন পঙক্তিমেলা, সভ্যতার চন্দ্রবিন্দু; গান—মন্দিরা, গান, কাজল মাটির গান, ইসলামী গান; প্রবন্ধ—সংগীতভাবনা; স্মৃতিগদ্য—আলো ছায়ার জোয়ার-ভাটা; শিশুসাহিত্য—মিতাভাইয়ের আসর, ফুলপাখিদের গান, আড়ি, টুনটুনি, নাটক নাটক, জয় মুক্তিযুদ্ধ, রবীন্দ্র নজরুল বঙ্গবন্ধু জয়নুল, জাগল বাঙালি জাগল, রয়েল বেঙ্গল, আড়ং, ছড়াকলাকার, মুজিবের নাম জয় বাংলা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

ছড়া ও নাটক নিয়ে আলোচনার জন্য ফজল-এ-খোদা ভাইয়ের আগারগাঁওয়ের বাসায়ও গিয়েছি। পেয়ারাগাছের ছায়ায় ঢাকা আঙিনাটি ভুলিনি আজও। আমাদের মধ্যে ছোটোখাটো গল্পের আসর বসে যেত। আমার রচিত নাটক পড়ে শুনিয়েছি তাঁকে। আমাদের গল্পের আসরে চায়ের আয়োজন করতেন কবিপত্নী শ্রদ্ধেয় ভাবি মাহমুদা সুলতানা। তিনি নিজেও একজন কথাসাহিত্যিক। কাজের অবকাশে তিনি আমাদের আলোচনায় অংশও নিতেন।

কবির জ্যেষ্ঠপুত্র ওয়াসিফ-এ-খোদা সবুজ তার ছাত্রজীবন বা বয়সের সীমানা পেরিয়ে আমাদের মতো বয়স্কজনের সঙ্গে সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপ-আলোচনা করত। আমার সঙ্গে কথা হতো শিশুসাহিত্য ও ছড়া নিয়ে। পিতার প্রতিটি বই সম্পর্কে তখনই ওর ধারণা ছিল সুস্পষ্ট। সাহিত্যের প্রতি গভীর আগ্রহের কারণে তাকে আমি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সে ছাত্রজীবন থেকেই ছড়া লিখছে।

বাংলাদেশ বেতারের অফিস শাহবাগ থেকে চলে এলো আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবনে। তার দোতলায় আমাদের কেন্দ্রীয় বার্তা সংস্থার কক্ষ। তখন বাংলা সংবাদ বিভাগের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করছি। মাঝেমাঝেই আড্ডা দিতে যাই ফজল-এ-খোদা ভাইয়ের দফতরে। সেখানে তাঁর পাশের চেয়ারে বসতেন কবি শামসুল ইসলাম। তাঁর ‘চালাকের বাজি’ প্রভৃতি শব্দ আমাদের হাসির খোরাক জোগাত। তাঁর কথা শুনে রাশভারী মানুষের পক্ষেও হাসি সংবরণ করা সম্ভব ছিল না। আমাদের মধ্যে সাহিত্যসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা হতো। কখনো কখনো হাস্যরসের গল্প গুরুগম্ভীর পরিবেশকে হালকা করে দিত। ফজল-এ-খোদা ভাই প্রাণখোলা হাসি হেসে পরিবেশ আনন্দময় করে তুলতেন।

বিচিত্র বর্ণের সেই দিনগুলো আর ফিরে আসবে না। যতদিন বেঁচে থাকি, সে সময়ের স্মৃতি অম্লান থাকবে মানস পটে।

৪ জুলাই ২০২৩, ঢাকা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *