"সালাম সালাম হাজার সালাম" গানের রচয়িতা

Fazl-E-Khuda (1941 – 2021)

আমি তাঁর ভালোবাসা পেয়েছি: মাহবুব রেজা

ফজল-এ- খোদা
আমি তাঁর ভালোবাসা পেয়েছি
মাহবুব রেজা

তিনি নব্বুইয়ের প্রথম দিকে সাপ্তাহিক মুক্তিবাণী’তে ছোটদের জন্যে একটি
অনিন্দ্য সুন্দর পাতা সম্পাদনা করতেন। সে পাতার নাম ছিল কচি পাতা। লেখা
ছাপা হলেই সম্মানি পেতাম। গল্পের জন্য আশি কখনো কখনো একশ- একশ
বিশ টাকাও পেতাম। ১৯৮৭-৮৮ সালে একজন কলেজ ছাত্রের জন্য এই টাকা
ছিল অনেক টাকা।
সে সময় এই পাতায় আমাদের মতন নবীন লেখকরা ভিড় জমাত। ভিড় জমানোর
আরও একটা কারণ ছিল তাহল কচি পাতা’র সম্পাদক ফজল-এ- খোদা ছিলেন
আমাদের মত উঠতি বয়সী ছেলেপেলেদের জন্য আড্ডার মধ্যমণি। তিনি
তরুণদের সঙ্গে আড্ডা দিতে, গল্পগুজব করতে ভালোবাসতেন। আর
ভালোবাসতেন তারা কি লিখছে, কি ভাবছে। কি পড়ছে- সব মিলিয়ে তিনি
আমাদের সঙ্গে আমাদের বয়সে এসে কথা বলতেন যেটা অন্য সম্পাদকদের
কাছ থেকে আমরা পেতাম না। তখনকার দিনে সাহিত্য পাতার সম্পাদক মানেই
একটু রাশভারী ধরণের মানুষ। সাধারণত সাহিত্য পাতার সম্পাদকরা নতুন
লিখিয়েদের দশ কথার বিপরীতে হু, হ্যাঁ- জবাবই দিতেন বেশি। লেখা দিতে গেলে
চেয়ারে বসতে বলতেন না, বললেও তা ছিল কালেভদ্রে।
সেই বয়সে আমরা আশা করতাম সম্পাদকদের রুমে লেখা দিতে গেলে তারা
আমাদের চেয়ারে বসতে বলবেন- বসার পর পিয়নকে ডেকে চা আনতে বলবেন-
দু’চার কথা বলবেন। সেরকম ভাগ্য খুব কমই হতো আমাদের মতো নবীন
লিখিয়েদের বেলায়। কিন্তু ফজল-এ- খোদা ছিলেন আমাদের কাছে একেবারে
অন্যরকম। তিনিই প্রথম যার কাছে আমরা সেরকম ব্যবহার পেয়েছিলাম।
তিনি নতুন লিখতে আসা ছেলেপেলেদের মনের কথাটা বুঝতে পারতেন, বুঝতে
পারতেন তাদের অন্তরের অব্যক্ত কথাটাও।

একবার।
১৯৮৭ সালের দিকে তিনি আমার কয়েকটি গল্প ছেপেছিলেন। তখনো তাঁকে
আমি দেখি নি। পত্রিকার অফিসে লেখা দিয়ে আসতাম- পরে সেই লেখা ছাপা
হতো। সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন তিনি অফিসে আসতেন। একদিন বিল আনতে
গেলে তিনি পত্রিকা অফিসের লোক দিয়ে আমাকে
ডেকে পাঠালেন। আমি একটু অস্বস্তিতে পড়লাম। কি হয়েছে, না হয়েছে সেই
চিন্তায় আমি শংকার মধ্যে ছিলাম।
তাঁর রুমে গেলে তিনি আমাকে বসতে বললেন। আমার সামনে বসে আছেন সালাম
সালাম হাজার সালাম’ কালজয়ী গানের অমর স্রষ্টা। একটু ভয়-ভয় করছে।
পিয়ন লোকটার হাতে টাকা দিয়ে চা- বিস্কিট আনতে বললেন। তারপর একথা
সেকথার পর বললেন,
‘মাহবুব, তুমি তোমার বাবা-মা হারানোর পর দুঃখ- কষ্টের দিনগুলো নিয়ে একটা
কিশোর উপন্যাস লেখো। কচিপাতায় আমি সেটা ধারাবাহিক ছাপাব।’
বলে কি!
আমি তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা আর
দৈনিক সংবাদে নিয়মিত গল্প ছাপা হচ্ছে আমার। শুক্কুরে শুক্কুরে সাত দিন
হল লিখছি আর সেই আমার মতো আনকোরা ছেলেকেই কি না তিনি বলছেন
উপন্যাস লিখতে!
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলাম তাঁর সামনে।
কিভাবে লিখব! মনের ভেতরে তোলপাড় চলছে, ভাবছি তখনই তিনি বললেন,
‘এত কি ভাবছো তুমি? শুরু করে দাও- দেখবে, তোমার ভেতর থেকে লেখাটা
আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে-‘
আমি বিস্ময়াবিভুত হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি।

‘শুরু করে দাও। দেখবে, তোমার ভেতর থেকে লেখাটা আস্তে আস্তে বেরিয়ে
আসছে-‘
পত্রিকা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে লিখতে শুরু করলাম ‘ঘর বাড়ি উঠান’
নামের কিশোর উপন্যাস। এক এক করে ছাব্বিশ পর্ব লিখেছিলাম কচিপাতায়।
এক সঙ্গে কয়েক পর্ব লিখে তার কাছে দিয়ে আসতাম। প্রতি পর্ব শেষ হলে
তিনি বাচ্চাছেলেদের মতো আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলতেন, ‘ভালো হচ্ছে, এর
পরের পর্বে কি লিখছো!’

আজ এত বছর পরে এসে এখন বুঝি আমাদের মতো নবীন লেখকদের কাছে তিনি
কতটুকু অনুপ্রেরণার ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই লেখালেখির প্রথম ছবকটা
শিখেছিলাম। মুক্তি বাণী অফিসে উচ্চারিত তাঁর সেই কথা এখনো আমার কানে
বাজে, ‘শুরু করে দাও। দেখবে, তোমার ভেতর থেকে লেখাটা আস্তে আস্তে
বেরিয়ে আসছে-‘
একজন নিরপেক্ষ, জাঁদরেল সম্পাদক হিসেবে ফজল-এ- খোদা আমাদের মতো
তরুণ লিখিয়েদের কাছে আদর্শের সেই জায়গাটা তৈরি করে দিতে পেরেছিলেন।
তিনি ভালো লেখাটাই তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায়, পাতায় ছাপতে কার্পণ্য
দেখাতেন না। তিনি লেখক ছাপতেন না, লেখা ছাপতেন।
২৬ আগস্ট, ২০২১
ইন্দিরা রোড, ঢাকা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *