"সালাম সালাম হাজার সালাম" গানের রচয়িতা

Fazl-E-Khuda (1941 – 2021)

ফজল-এ-খোদা এবং শাপলা শালুক:আমীরুল ইসলাম

ফজল-এ-খোদা এবং শাপলা শালুক
আমীরুল ইসলাম
স্বল্পায়ু এক ছোটোদের পত্রিকার নাম ‘শাপলা শালুক’।
সোয়া দুই বছরে ২৬টা সংখ্যা বের হয়েছে। ১৯৭৪ থেকে ৭৬
সালে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী
অস্থির সময়। দেশ পুনর্গঠনের কাজে সর্বমহল সক্রিয়।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ নতুনভাবে গড়ে
উঠছে। চারিদিকে নানামুখী কার্যক্রম। শিল্প উন্নয়নের
পাশাপাশি সংস্কৃতি উন্নয়নেও সবাই সচেষ্ট। তখন
সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগেও নানা
কাজ হচ্ছে। ছোটোদের জন্য তখন অনেক উদ্যোগ।
আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ তখন সারা পৃথিবীর কাছে
অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কচি-কাঁচার মেলা,
খেলাঘর, বয় স্কাউট, গার্ল গাইডস বিভিন্ন সংগঠন দেশ
গঠনের কাজে উৎসর্গ করেছে নিজেদের। বঙ্গবন্ধু নিজে
ছিলেন প্রচণ্ড শিশুপ্রেমিক। তিনি কোনো দেশে কোনো
রাষ্ট্রীয় কাজে অংশ নিতে গেলে সঙ্গে করে ছোটোদের
আঁকা ছবি নিয়ে যেতেন উপহার দেয়ার জন্য। তিনি সময়
পেলে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। বিভিন্ন স্থির ছবির
মধ্যে সেইসব স্মৃতি হয়ে আছে।
শিশুদের মানস গঠনে রেডিও-টেলিভিশনে ছোটোদের
অংশগ্রহণে অনুষ্ঠান নির্মাণ করা হতো। বাংলাদেশ
বেতারের উদ্যোগে ‘শাপলা শালুক’ নামে একটা অনুষ্ঠান শুরু
হয়। পরে এই নামে ছোটোদের একটি পত্রিকা বেতার
প্রকাশনা দপ্তর থেকে প্রকাশের পর ‘শাপলা শালুকের
আসর’ নামে একটি শিশু-কিশোর সংগঠনের জন্ম হয়।

‘শাপলা শালুক’ ছিল ভিন্নধর্মী প্রকাশনা। বহু বর্ণের
কাগজে ছাপা। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পরিচয়
থাকত এই পত্রিকায়। সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত কবি,
গীতিকার ও মুক্তিযোদ্ধা ফজল-এ-খোদা। সংগঠনের সুবাদে
তাঁর পরিচিতি হয়েছিল ‘মিতাভাই’ নামে। তিনি চাকরিসূত্রে
বাংলাদেশ বেতারের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের সকল
সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও অপরিসীম মনোবলে ‘শাপলা
শালুকের আসর’ গড়ে তোলেন। দেশজুড়ে অতি দ্রুত এই
সংগঠন ব্যাপ্তিলাভ করে। সেইসঙ্গে ‘শাপলা শালুক’
পত্রিকাটিও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নবীন-প্রবীণ লেখকের
সমাহারে ‘শাপলা শালুক’ ভিন্নতা অর্জন করে।
॥দুই॥
‘শাপলা শালুক’ ছিল রয়্যাল সাইজ। দু রঙে ছাপা হতো। লেখা
কালো হলে ছবি সবুজ বা লাল। লেখা লাল হলে ছবি নীল।
প্রথম সংখ্যা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। ‘শাপলা শালুক’
নামলিপির নিচে ব্র্যাকেটে লেখা ছিল ‘বেতার কিশোর
মাসিক’। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় থেকে কয়েকটা
পঙক্তি উদ্ধৃত করছি—‘বেতার-বিশ্বে বেতার প্রকাশনায়
ছোটদের মুখপত্র হিসেবে কোন পত্র-পত্রিকা ছাপা হতো
কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু যতদূর জানা যায় বেতারের
মোট শ্রোতাদের এক বিরাট অংশ শিশু ও কিশোর-কিশোরী।
ছোটদের মানস গঠনে ও সুকুমারবৃত্তি বিকাশে বেতারের
ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই বাংলাদেশ বেতারের ‘বেতার
প্রকাশনা দফতর’ শিশু-কিশোর শ্রোতাদের উপযোগী একটি
মাসিক পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আর
তাই এই “শাপলা শালুক”।’

জসীমউদদীন, সুফিয়া কামাল, রশীদ হায়দার, শামসুর
রাহমান, ফজল-এ-খোদা, আবদুল্লাহ আল মুতী প্রমুখ
বরেণ্য লেখকের লেখায় প্রথম সংখ্যা সমৃদ্ধ। প্রথম
সংখ্যার প্রচ্ছদ কাইয়ুম চৌধুরী; ভেতরের ছবি মহিউদ্দীন
ফারুক। প্রথম সংখ্যা অতি সুসজ্জিত ও সুসম্পাদিত। যে
কোনো লেখার সঙ্গে একাধিক অলংকরণ ব্যবহার করা
হয়েছে।
দ্বিতীয় সংখ্যার দিকে তাকানো যাক। ইফাত মাহমুদের
আঁকা প্রচ্ছদ। সদ্য প্রয়াত লোকসংগীতের জাদুকর
আবদুল আলীমকে নিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। লিখেছেন
সরদার জয়েনউদ্দিন, ফজল-এ-খোদা, আল কামাল আবদুল
ওহাব, আবু কায়সার, সুকুমার বড়ুয়া প্রমুখ। বেতারে
প্রচারিত ছোটোদের অনুষ্ঠানের মাসিক সময়সূচি, শাপলা
শালুকের আসর সংগঠনের সংবাদ, ছোটোদের লেখা ও
আঁকা। আর প্রতিটা লেখার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে
ইলাস্ট্রেশন।
তৃতীয় সংখ্যা ছিল ঈদ সংখ্যা। প্রথম বর্ষেই ছিল
আড়ম্বর। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাস। বাংলাদেশ তখন
অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। ঈদ সংখ্যা শুরু হয়েছে জেবু
আহমেদের লেখা দিয়ে। আলী ইমাম, মাহমুদউল্লাহ,
ফওজিয়া খান, সৈয়দ আশরাফ আলী প্রমুখের লেখা।
ফওজিয়া খানের দীর্ঘ রূপকথার গল্প।
এই পত্রিকায় তৎকালীন খ্যাতিমান সকল শিশুসাহিত্যিক
নিয়মিত লিখেছেন। হাবীবুর রহমান, কাজী আফসার উদ্দিন
আহমদ, মোহাম্মদ নাসির আলী, রোকনুজ্জামান খান,
আলমগীর জলিল, আলী ইমাম, আবু কায়সার,

মাহমুদউল্লাহ, শামসুর রাহমান, রোকেয়া খাতুন রুবী,
শামসুল হক, হাসান জান, বদরুল হাসান প্রমুখ।
ঈদ সংখ্যা ছাড়াও বর্ষা সংখ্যা, বিজয় দিবস সংখ্যা,
স্বাধীনতা সংখ্যা—এইভাবে প্রতিটা সংখ্যাকে বিশেষ
মর্যাদা দেয়া হতো।
ফজল-এ-খোদাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। আমাদের শিশুসাহিত্য
তাঁর কাছে ঋণী। তার আগে প্রকাশিত ছোটোদের পত্রিকা
ছিল ‘শাহিন ও সেতারা’, ‘খেলাঘর’, ‘মুকুল’, ‘আলাপনী’,
মাসিক ‘কচি ও কাঁচা’, ‘টাপুর টুপুর’, ‘নবারুণ’, ‘ধানশালিকের
দেশ’ ইত্যাদি। তবে স্বীকার করতেই হবে—এইসব
ফরম্যাটের বাইরে ‘শাপলা শালুক’ প্রকাশিত হয়েছিল। খুব
ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন পত্রিকা। কোনো পাতায় কোনো বাহুল্য
নেই। মুক্ত বাতাস খেলে যাচ্ছে প্রতি পাতায়। ছোটোদের
জন্য মন ভরানো ছবি। কাইয়ুম চৌধুরী, মহিউদ্দীন ফারুক,
গোলাম সারোয়ার, শেখ তোফাজ্জল হোসেন, আফজাল
হোসেন প্রমুখ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করতেন। ১৯৭৪ সালে
আঁকা আফজাল হোসেনের প্রচ্ছদ দেখে সত্যি সত্যি
অবাক হতে হয়।
আজীবন ফজল-এ-খোদা ছিলেন তরুণদের পৃষ্ঠপোষক। তরুণ
লেখক ও তরুণ শিল্পী তৈরি করার ব্যাপারে তাঁর ছিল বিপুল
উৎসাহ। যার ভেতরে সামান্য প্রতিভা আছে তাকেই তিনি
যত্ন করেছেন। তিনি ছিলেন প্রতিভাবানদের পূজারী।
ফজল-এ-খোদা কবি ও শিশুসাহিত্যিক। আর ছিলেন বিখ্যাত
গীতিকার। অনেক স্মরণীয় গান তিনি লিখেছেন।

‘শাপলা শালুক’ সম্পাদনা করাও তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তি।
আমাদের শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম অক্ষয় হয়ে
থাকবে।
৩০। ০৭। ২১

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *