"সালাম সালাম হাজার সালাম" গানের রচয়িতা

Fazl-E-Khuda (1941 – 2021)

‘বেতার বাংলা’, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাহিত্য-পত্রিকা

‘বেতার বাংলা’, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাহিত্য-পত্রিকা
ইসরাইল খান
দৈনিক ইত্তেফাক : ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বাংলাদেশ বেতারের পাক্ষিক অনুষ্ঠান-পত্রিকা হিসাবে পরিকল্পিত হলেও ‘বেতার
বাংলা’ ছিল বস্ত্ততপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাহিত্য পত্রিকা। ১৯৭২ সালের
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এক মাসের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়
বাংলাদেশ বেতারের মুখপত্র হিসাবে ‘বেতার বাংলা’ প্রকাশ করা হবে। দেশ গঠনের জন্য
গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাহিত্যের কাগজ প্রকাশের কথা কেউ তখনো ভাবেননি। এরূপ
পরিস্হিতিতে প্রাতিষ্ঠানিক মুখপত্র হওয়া সত্ত্বেও ‘বেতার বাংলা’ সে-সময়ে পালন
করেছিল প্রথম শ্রেণির সাহিত্যপত্রিকার ভূমিকাও। বাংলাদেশের সাহিত্য ও
সংস্কৃতির অগ্রগতির ইতিহাসে তাই এর ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বলে রাখা প্রয়োজন, প্রথম প্রকাশের পরেই বেতার বাংলার সাফল্য ও সুখ্যাতির
কারণে ফজল-এ-খোদার বিরুদ্ধে একটি কুচক্রীমহল তত্পরতা চালাতে শুরু করে যাতে
তাঁর নাম ‘সম্পাদক’ হিসাবে টাইটেল পেজে ছাপা না-হয়! এর ফলে আমরা দেখতে পাই,
দ্বিতীয় থেকে ১২/১৩টি সংখ্যার টাইটেল পেজে সম্পাদক হিসাবে কারো নামই ছাপা
হয়নি। শুধু শেষ প্রচ্ছদের নিচে প্রিন্টার্স লাইনে ‘বাংলাদেশ বেতারের পক্ষে ঢাকার
আঞ্চলিক পরিচালক কর্তৃক প্রকাশিত’; কখনোবা, ‘সম্পাদিত ও প্রকাশিত’ কথাটি
লেখা থাকত। মাস ছয়েক এভাবে চলার পরে ‘চরমপত্র’-খ্যাত মহান শব্দসৈনিক এম.
আর. আখতার মুকুল বেতারের মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ বেতার
যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল। ফজল-এ-খোদার ওপর মানসিক নির্যাতনকারীরা সুবিধা
বঞ্চিত হলো। অতঃপর, দু-তিনটি সংখ্যার প্রিন্টার্স লাইনে ‘মহাপরিচালক কর্তৃক
প্রকাশিত’ ও পরে ‘প্রকাশিত ও সম্পাদিত’ কথাটুকু লেখার পরে মহাপরিচালক মুকুল
সাহেব সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও মর্যাদা দিয়ে ফজল-এ-খোদার ওপর বেতার বাংলার
দায়িত্ব অর্পণ করেন। প্রথম বর্ষ ২৪ সংখ্যা থেকে ফজল-এ-খোদার নামই বেতার

বাংলায় টাইটেল পৃষ্ঠায় ১৯৭৫ বা তত্পরবর্তীকালে মুদ্রিত হয়েছে। তিনি বেতার বাংলার
বেশকিছু বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন জাতীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবস উপলক্ষে
এবং অমর কণ্ঠশিল্পী সরদার আলাউদ্দিন, কবি-গীতিকার সিকান্দার আবু জাফর, কবি
আবুল হাসান ও ১৯৭৫ সালের সময়সীমার মধ্যে যাঁরা প্রয়াত হয়েছিলেন—প্রত্যেকের
ওপর বেতার বাংলা প্রচ্ছদকাহিনির মর্যাদা দিয়ে সংখ্যা প্রকাশের মধ্য দিয়ে জাতির
পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রয়াস গ্রহণ করে সুধীমহল থেকে বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন।
চার বছরের প্রায় সমস্ত সংখ্যা আমি উলটে-পালটে দেখেছি। এর প্রতিটি সংখ্যার
প্রচ্ছদ এক-একটি চমত্কার চিত্রশিল্প হিসেবে লোভনীয় ঐতিহ্যিক চিত্র ও
ফটোগ্রাফিসামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। এইসব কর্মের জন্য দিনে-দিনে সম্পাদক ফজল-
এ-খোদার অনুদ্ঘাটিত আরেক সত্তা আমাদের সামনে উন্মোচিত হতে শুরু করে।

দুই

ফজল-এ-খোদা জাতশিল্পী হওয়ার কারণে অনুষ্ঠানাদির বিবরণ বা প্রোগ্রাম-সূচি
প্রকাশ তাঁদের প্রধান মটো হলেও বেতার বাংলা হয়ে উঠেছিল তখনকার লেখকদের
অভিপ্সিত একটি সাহিত্য-পত্রিকা। আবুল ফজল, মুহম্মদ এনামুল হক, জসীমউদ্দীন,
শামসুর রাহমান, আবদুল কাদির এমনকি সৈয়দ মুজতবা আলী, অন্নদাশঙ্কর রায়, বিষ্ণু
দে, মনোজ বসু প্রমুখ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রধান কবি-সাহিত্যিকগণ সম্পাদক-
কবি ফজল-এ-খোদার অনুরোধ উপেক্ষা না-করে বেতার বাংলার সৌষ্ঠবপূর্ণ পৃষ্ঠাজুড়ে
নানান রকমের রচনা দিয়েছেন প্রকাশের জন্য।

আজ এই অবিস্মরণীয় সাহিত্য সাময়িকীর বয়স পঞ্চাশ বছর হতে চলল। প্রথম
প্রকাশ ঘটেছিল এর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ‘জাতীয় শোক ও শহীদ দিবস সংখ্যা’
রূপে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে (১৯৭২-৭৫) এবং তার পরও বছরখানেকের বেশি ফজল-এ-
খোদার সম্পাদনায় বেতার বাংলা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। জিয়াউর রহমানের
শাসনামলে আদর্শগত কারণে ফজল-এ-খোদাকে অব্যাহতি দেয়া হলে বেতার বাংলাও

নতুন রূপ ধারণ করে। প্রথম পর্বেও বেতার বাংলার সাড়ে চার বছরের সংখ্যাগুলোর
জীর্ণদীর্ণ পাতাগুলো উলটে সূচিগত ইতিহাসটা পর্যবেক্ষণ করলে স্বীকার করতেই
হবে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে বেতার বাংলা পালন করেছিল বিরাট
বিপুল তাত্পর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা। কিন্তু গবেষকগণ ‘বেতার বাংলা’র নামের
কারণেই একে এড়িয়ে গিয়েছেন বলে মনে হয়। কিন্তু যে-কেউ এর পাতাগুলো উলটালে
তিনি হয়তো পেয়ে যাবেন ইতিহাস-ঐতিহ্য সংক্রান্ত অনেক অগ্রম্হিত রচনা এবং
ইতিহাসের আলোকে মূল্যবান অনেক আকর তথ্য।

তিন

একুশে ফেব্রুয়ারির পক্ষে প্রকাশিত বলে প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ খচিত হয়েছিল অ-
আ-ক-খ বর্ণমালায়। ভেতরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণরত ছবিসহ বাণী। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে
দেয়া বাণীগুলোর মধ্যেই স্হান হবে তাঁর এই ‘বাণী’। মহান একুশের বিশেষ সংখ্যার এই
বাণী ছিল তাঁর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ‘ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত প্রথম
বাণী’

—‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার জন্য আন্দোলন ছিল না, বরং তা ছিল
সাংস্কৃতিক স্বাধিকার, আর মানুষের মতো বাঁচার অধিকারের সংগ্রাম। সেদিন থেকে শুরু
হয়েছিল চরম সংগ্রামের প্রস্ত্ততি। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ থেকেই এ সংগ্রাম শুরু
হয়। সেটা শুধু ভাষা আন্দোলনই ছিল না এবং কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনই সেদিন শুরু
হয়নি—এ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা
আন্দোলন।

এরপর জাতীয় সংগীত—‘আমার সোনার বাংলা’ ও ‘রণ সংগীত’—‘চল চল চল’—পরপর দু
পৃষ্ঠায় গাঢ় সবুজ রঙের পটে মুদ্রিত।

‘পরিচিতি’ নাম দিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হয় ‘জাতীয় শোক ও শহীদ দিবস’ প্রসঙ্গে। এই
ঘোষণাটি পত্রিকার ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ-

‘একুশে ফেব্রুয়ারি—আটই ফাল্গুন, জাতীয় শোক দিবস। এই দিবস এবার এসেছে নতুন
পরিবেশে, নতুন তাত্পর্য নিয়ে। স্বাধীন দেশে স্বাধীন জাতি হিসেবে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-
সম্প্রদায় নির্বিশেষে এই পবিত্র দিনটি একান্ত অন্তরঙ্গ আলোকে উদযাপন করা
হবে।

‘এবারের একুশে শপথ নিতে হবে স্বাধীনতার নির্যাস প্রতিটি নাগরিকের নিকট পৌঁছে
দেবার সংগ্রামে নিজেকে উত্সর্গ করার জন্য। মাতৃভাষার উন্নতি বিধানের ব্যাপারে
সকল প্রচেষ্টাকে নিয়োজিত করতে হবে।…

’বেতার বাংলার প্রথম সংখ্যার প্রথম রচনা ছিল আবুল ফজলের প্রবন্ধ—‘ভাষার যাদু
শক্তি’। তিনি বলেন, ‘ভাষা যে এক বিরাট ঐক্যসূত্র এবারকার সংকটে তা আরো ভালো
করে প্রমাণ হলো। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় ভাগটা ছিল হিন্দু-মুসলমানে। এবার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভাগটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাভাষী আর
উদু‌র্ভাষীদের মধ্যে। যারা দেশের নিরাপত্তা বাহিনীতে রয়েছে তাদের মধ্যেও ভাগটা
এসেছে ভাষার ভিত্তিতেই। ধর্মের চেয়েও ভাষার জোর অনেক বেশি, তাও এবার প্রমাণ
হলো নিঃসন্দেহরূপে।’

এই পত্রিকার প্রথম কবিতাটি ছিল শামসুর রাহমানের—‘কী করে লুকাবে?’—
‘কী করে লুকাবে বলো এইসব লাশ?
এইসব বেওনেট-চেরা,
বিষম নাপাম-পোড়া লাশ?

এ-তো নয় বালকের অস্হির হাতের
অত্যন্ত প্রমাদময় বানানের লিপি,
রবারে তুমুল-ঘষে তুললেই নিশ্চিত
মুছে যাবে। অথবা উজাড় ঠোঙা নয় মিষ্টান্নের
কিংবা খুব ক্ষয়ে-যাওয়া সাবানের টুকরো,
অথবা বাতিল স্পঞ্জ, দূর
ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিলেই বেবাক
চুকেবুকে যাবে।
কী করে লুকাবে বল এত বেশি লাশ?’

ড. নীলিমা ইব্রাহিম লিখেছিলেন— ‘নবজীবনের সুপ্রভাতে বেতার বাংলা’। তিনি বলেন,
‘বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি তার সহজ স্বাভাবিক গতিধারা, উন্নয়ন ও
প্রসারতায় যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি বাধা ও বিরোধিতা প্রাপ্ত হয়েছিল তা হচ্ছে
‘পাকিস্তান বেতার জগত্’। এ জগত্ আমাদের অর্থাত্ বাঙালি জাতীয়তাবাদকেও, তার
স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে ধুয়ে মুছে ফেলতে সদা প্রয়াসী ছিল, পাকিস্তান-বেতার
বাংলাভাষাকে যত সহজে বিকৃত করে প্রচার করেছে এবং কৃত্রিম ভাষাকে চালু করতে
চেয়েছে অন্য কোনো মাধ্যম এত বেশি ভাষাকে বিকৃত ও খর্ব করতে পারেনি বা পারবার
সুযোগও তাদের ছিল না।

‘রবীন্দ্র-বর্জনের সুযোগও করে দিয়েছিল এই পাকিস্তান রেডিও।

‘আমরা নিজেকে চিনতে পারব, আমাদের দেশ তার কত আপন সে সত্য আমরা জানতে
পারব এই বেতার বাংলা মাধ্যমে—আজ এই কামনা আমরা করব।

‘এই সুখানুভূতি নিয়ে বেতার বাংলাকে আমরা অভিনন্দন জানাই নবজীবনের সুবর্ণ
প্রভাতে।’

আশি পৃষ্ঠার তিন কলামের ডাবল ক্রাউন সাইজের পত্রিকার পঁয়ষট্টি পৃষ্ঠাজুড়েই ছিল
সাহিত্য—প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা। আরো কবিতা লিখেছিলেন জিয়া হায়দার, বেলাল
মোহাম্মদ, হুমায়ুন আজাদ, জুলফিকার মতিন, দিলওয়ার হোসেন, বেবী আনওয়ার, সৈ না
মো. আয়াত উল্লাহ; মযহারুল ইসলাম (প্রবন্ধ) সংগ্রামে দুইটি সূর্যচেতনা; রাবেয়া
খাতুন (গল্প) একাত্তরের একটি অপ্রকাশিত গল্প; আলাউদ্দিন আল আজাদ
(কথিকা/মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি নিয়ে) কোনোদিন ভুলব না; রাহাত খান (মুক্তিযুদ্ধের
গল্প) আর হয়নি দেখা; সুফিয়া খানম (প্রবন্ধ) ভাষা আন্দোলন; আবদুল তোয়াব খান
(বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচারিত কথিকা-প্রবন্ধ) বিশ্বের চোখে শেখ মুজিব; এ কে
এম আনোয়ার হোসেন (প্রবন্ধ) একুশে ফেব্র‚য়ারি ও বাংলা ভাষা; সিরাজউদ্দিন
আহমেদ (গল্প) হাত; গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তত্কালীন মন্ত্রীবর্গের
সচিত্র অ্যালবাম; রফিকুল ইসলাম (প্রবন্ধ) পাকিস্তানে বাংলা ভাষা বিরোধী
ষড়যন্ত্র; শহীদুল ইসলাম (মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা) মৃতু্যকে যেমন দেখেছি; টি এইচ
সিকদার (ইতিবৃত্ত) স্বাধীন বাংলা বেতারের তথাকথিত ইতিহাস; রণেশ দাশগুপ্ত
(প্রবন্ধ) তোরা সব জয়ধ্বনি কর; ফয়েজ আহমদ (স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত
প্রবন্ধ) পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে; আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (স্বাধীন বাংলা বেতারে
প্রচারিত কথিকা) পুতুল নাচের খেল।


এই লেখার লিঙ্ক-
https://www.ittefaq.com.bd/488781/%E2%80%98%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%BE%
E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E2%80%99-
%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A7%E0%A7%80%E0%A6%A8-
%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6
%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A5%E0%A6%AE

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *