"সালাম সালাম হাজার সালাম" গানের রচয়িতা

Fazl-E-Khuda (1941 – 2021)

‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের ইতিহাস

Salam salam

‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের ইতিহাস

ফজল-এ-খোদা

১৯৬৯ সাল। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ভুয়া আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানের পাঞ্জাবি আর্মিরা। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর শামসুজ্জোহাকে পাকিস্তানের আইয়ুবের বর্বর আর্মি নৃশংসভাবে হত্যা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি খুলনায় পাকিস্তানি পুলিশ ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি করে ৮ জন বাঙালিকে হত্যা করে। ২২ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের কারণে বঙ্গবন্ধু এবং সকল বাঙালি রাজবন্দীকে পাকিস্তান সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বললেন ‘মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যে সূর্যসন্তানেরা রাজপথ রাঙিয়ে গেলেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ভাষা আমার নেই। আজকের দিনে কোটি কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও বলি জয়, ছাত্র-জনতার জয়।’

এইসব হত্যার কারণে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা) দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ। আমিও ভীষণভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। বাঙালিরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্যে প্রাণ দিচ্ছে। আমার মনে প্রশ্ন- পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের মানুষের মধ্যে কি এত শহিদ আছে? এই সময়ে একদিন ঢাকা বেতার কেন্দ্রে শিল্পী বশির আহমদ এল। বলল- বাসায় একবার আস, দু-একটা গান করি চল। বশিরের বাসায় গেলাম ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে। আমি বশিরকে বললাম- অনেক রোমান্টিক গান তো করলে, এবার একটু ভিন্ন স্বাদের গান করলে কেমন হয়? বশিরও খুব উৎসাহ দেখাল। আমি বললাম- ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি শুধু ভাষাশহিদদের জন্যে লেখা হয়েছে। কিন্তু ভাষাশহিদ ছাড়াও পাকিস্তানিদের অন্যায়-জুলুমের জন্যে কত বাঙালিকে শহিদ হতে হচ্ছে তার হিসেব নেই। সকল শহিদকে শ্রদ্ধা জানানো যায় এমন একটি গান লিখলে কেমন হয়। আমরা শহিদদের সালাম জানাতে পারি এবং আরো বললাম, শহিদদের শুধু সালাম জানালেই হবে না; স্বাধিকার ও সংস্কৃতির জন্যে সেই সিরাজ, তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন থেকে শুরু করে আজকের জহুর-জোহা-আসাদ-মতিউর পর্যন্ত আরো কত নাম-না-জানা বাঙালি যে সংগ্রাম করে শহিদ হচ্ছে, সেই অব্যাহত সংগ্রামের কথা এই গানে থাকতে হবে।

বশির সোৎসাহে আমার সঙ্গে একমত পোষণ করল। আমি আর বশির মিলে প্রস্তাবিত গানটির কাঠামো ও সুর নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম। এই আলোচনায় বশিরের স্ত্রী মিনা বশিরও আমাদের দুজনকে উৎসাহিত করল। আমি ভাবতে থাকলাম, গানটি কিভাবে কী কী কথা দিয়ে সাজানো যায়? তখন বশির থাকে হাতিরপুলের মোড়ে দোতলায় আর আমি থাকি এখনকার বাংলামোটরের জহুরা মার্কেটের পেছনে। তখন রাত প্রায় এগারোটা, রিকশায় আসতে আসতে আমার মনে হঠাৎ একটা বাণী গুনগুনিয়ে উঠল- ‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহিদ স্মরণে’। আমি বারবার কথাটি একটা সুরের মধ্যে বলতে বলতে একটা ঘোরের মধ্যে আওড়াতে থাকলাম- সালাম সালাম…। যতই আওড়াই ততই ভালো লাগে।

আওড়াতে আওড়াতে বাসায় পৌঁছে গেলাম। তখন আমার বড়ো ছেলে সবুজকে কাঁধে নিয়ে আমার স্ত্রী ঘুম পাড়াচ্ছে। আমি খেতে খেতে বশিরের সঙ্গে আলোচনার কথা, আমার ভাবনার বাক্যটির কথা সবুজের মাকে বললাম। সে বলল- দারুণ হয়েছে। খেয়ে নাও আগে, তারপর লিখে ফেলো। তোমাকে কেউ এখন ঝামেলা করবে না।

হ্যাঁ, আমার আবার একেবারে নিজঝুম পরিবেশ না হলে তেমন মনের মতো করে লেখা হয় না। পড়ার টেবিলে বসে একটা সিগারেট ধরিয়েছি কি- ব্যাস, বলতে গেলে গানটি একটানে লিখে ফেললাম। লিখে চিৎকার- শুনছ! ডাক শুনেই সবুজের মা উঠে এল। আমি আবৃত্তির ঢঙে তাকে গানটি পড়ে শোনালাম। শুনেই সে অস্ফুট শব্দ করল- চমৎকার! এমন ঢালাওভাবে সায় দেবার মেয়ে সে নয়। তারও গদ্যে চমৎকার হাত আছে। তাছাড়া সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্রী। শুধু সে একটি বাক্য সম্পর্কে মৃদু আপত্তি করল। বাক্যটি হলো- বাংলাদেশের লাখো বাঙালি/জয়ের নেশায় চলে রক্ত ঢালি; এই ‘রক্ত ঢালি’ কথাটায় তার আপত্তি। তার যুক্তি হলো এই ‘রক্ত ঢালি’ কথাটা থাকলে রেডিও-টেলিভিশন গানটি প্রচার করবে না। আমি বললাম, বশিরকে আগে দেখাই- দেখি বশির কী বলে? তখন রাত দেড়টা; ইংরেজি হিসেবে আর ২৪ ফেব্রুয়ারি নেই, ২৫ ফেব্রুয়ারি হয়ে গেছে। তবু গানটি লেখা শেষ করেই আমি তারিখ বসিয়েছি ২৪/২/৬৯। লিখে ফেলেছি যখন তখন আর তারিখ বদলালাম না।

পরের দিন রেডিওতে যাওয়ার আগেই বশিরের বাসায় গেলাম। ওর কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিল। বশিরের দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। আমি বসে থাকলাম। ও উঠল। তারপর ওকে আমি একইভাবে গানটি পড়ে শোনালাম। বশিরও গানের কথার ব্যাপারে খুঁতখুঁতে। কিন্তু কী আশ্চর্য- ও শুনেই বলল, ভালো হয়েছে। আমি গানটি ওকে দিয়ে অফিসে চলে এলাম। আমি তখন রেডিও পাকিস্তানের প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক এলান পত্রিকার সহসম্পাদক হিসেবে চাকরি করি। এরপর গানটির ব্যাপারে বশিরকে দু-একবার জিজ্ঞেস করেছি, ও বলেছে তাড়াহুড়োর কী আছে? সুযোগ পেলেই করে ফেলব।

১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী হলেন। কিন্তু তখনকার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকতে নানারকম টালবাহানা করতে লাগল। আর বাঙালিরা হতে থাকল বিক্ষুব্ধ। শেষে ইয়াহিয়া ’৭১ সালের ৩ মার্চ অধিবেশনের দিন ধার্য করল। কিন্তু হঠাৎ করেই ১ মার্চ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলো। আর যায় কোথায়- সারা দেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ল। বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী ২ মার্চ পূর্ণ দিবস হরতাল ডাকলেন। স্বতঃস্ফ‚র্ত হরতাল পালিত হলো। ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হরতাল চালিয়ে যেতে বললেন। বাঙালিরা তাদের ন্যায্য দাবি জানাতে গিয়ে ঢাকার সেন্ট্রাল জেলের বন্দীসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী-খুলনা-রংপুর-সিলেটে পাকিস্তানের আর্মি ও পুলিশের গুলিতে প্রায় তিনশ জন শহিদ হলো। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিলেন। সারা দেশের মানুষ জয় বাংলা ধ্বনিতে বঙ্গবন্ধুর পেছনে এসে দাঁড়াল। সেদিনই বাংলাদেশে জিন্দাবাদের কবর হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু যা বলেন বাঙালিরা তাই করে। বঙ্গবন্ধু তখন বাংলাদেশের মুকুটহীন সম্রাট। ১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু বললেন- এখন থেকে রেডিও-টেলিভিশনে আর পাকিস্তানের গান বাজবে না, বাজবে বাংলা ও বাঙালির গান। ব্যাস রেডিও-টেলিভিশন থেকে পাকিস্তানের গান বন্ধ হয়ে গেল। ইতিমধ্যেই আমি টেলিভিশনের জন্যে একটি গান লিখেছি।  শিল্পস্রষ্টা মুস্তাফা মনোয়ারের প্রযোজনায় সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমানের সুরে আবদুল জব্বার, ফেরদৌসী রহমান, আবদুল আলীম, সৈয়দ আবদুল হাদী, সৈয়দ ফারুক আহমেদ, সিদ্দিকী, আঞ্জুমান আরা, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, খুরশিদ আলমসহ সমস্ত প্রথম সারির মোট ১৭ জন শিল্পীর কণ্ঠে গানটি প্রতিদিনই প্রচারিত হতে থাকে। গানটির কথা হলো-

সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম,

চলবে দিনরাত অবিরাম\

চুষে খায় যারা মানুষের খুন

জনতার ঘরে লাগায় আগুন

সেই খুনিদের মুছে ফেলো নাম\……

শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর জনসভায় গান গাইতে শুরু করে। এজন্যে জব্বারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দারুণ ঘনিষ্ঠতা হয়। আর তখন জব্বারের অধিকাংশ বেতার-টেলিভিশনের গান আমি লিখে দিই। মার্চের অসহযোগ শুরু হতেই প্রতিদিনই জব্বারের জন্যে গণসংগীত বা সংগ্রামী গান একটি-দুটি লিখতেই হতো।  আজ রিকশা মিছিল কাল বস্তিবাসীর মিছিল এভাবে কোনো না কোনো মিছিলে জব্বার নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে তার উদাত্ত মধুর কণ্ঠের গানে। সব মিছিলের ঠিকানা তখন বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি, ধানমন্ডি। এরকম মিছিলে আমার রচিত একটি গান-

বাংলার জয় মানে না যারা

পিটাও তাদের পিটাও!

মানব নামের দানব কুলের

অলীক স্বপ্ন মিটাও\…..

গানটি বঙ্গবন্ধুর খুব পছন্দ হয়। আমি আর জব্বার প্রতিদিনই রাত্রে বঙ্গবন্ধুর সামনে হাজির হই। বঙ্গবন্ধু আজ কী বলবেন তাঁর মুখ থেকে শুনতে ভালো লাগে। একদিন তাঁর সামনে যেতেই তিনি জব্বারকে উদ্দেশ্য করে বললেন- তুই আজকের মিছিলে একটা দারুণ গান গাইছিস। শোনা তো গানটা। জব্বার গেয়ে শোনাতেই বঙ্গবন্ধু উচ্ছসিত হয়ে ওঠেন- আমরা শয়তানদের লাঠি দিয়ে পিটায়া সোজা করতে পারতেছি না, আর তোরা কলম দিয়ে পেটাতে শুরু করলি? পিটা, পিটা আরো পিটা, আরো এরকম অনেক গান চাই এখন। বঙ্গবন্ধুর এই কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজে।

২ মার্চ থেকে বলতে গেলে আমরা বেতারের সবাই অসহযোগ করছিলাম। কিন্তু বেতার সচল রাখা হয়েছিল বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করা ও উদ্দীপ্ত রাখার জন্য। তাই সরকারি বিধি অনুসারে অফিস না করে আমরা সবাই শাহবাগের বেতারভবনে নিয়মিত উপস্থিত থাকতাম। তাছাড়া বেতার তখন শিল্পী-কবি-কুশলীদের মিলিত হবার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। না হলে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে (আজকের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর) দেখা হতোই। ১১ মার্চ সম্ভবত সকাল দশটায় হন্তদন্ত হয়ে জব্বার এসে উপস্থিত। আমরা তখন কয়েকজন বেতারের আবন মিয়ার ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিলাম। জব্বার এসেই আমার হাত টেনে ধরে- চা রাখ, চলো।

– কোথায়?

– কবি, কোনো কথা নয়। ওঠো।

আমি জোর করে তাকে পাশে বসাই এবং আবন ভাইকে বলি এক কাপ চা দিতে। বলি- এক কাপ চা খাবে, তারপর যেখানে বলবে যাব; যা করতে বলবে তাই করব।

জব্বারের কথায় জানা গেল, বঙ্গবন্ধু গতকাল বলেছেন- বেতার টেলিভিশনে বাংলার গান হতে হবে। আর আমাকে হুকুম দিয়েছেন তোমাকে দিয়ে গান লেখাতে। এমন গান, যে গানে শহিদদের স্মরণ করা হবে, আবার মানুষ শহিদ হওয়ার জন্যে প্রাণ বাজি রাখবে।

জব্বারের কথা শুনেই আমার ‘সালাম সালাম’ গানটির কথা মনে পড়ে গেল। আশ্চর্য, এতদিন গানটির কথা একবারও মনে হয়নি। বললাম, একটি গান লেখাই আছে।

– কোথায়?

– বাসায়।

– চলো, এক্ষুনি চলো। পছন্দ হলে ভালো, না হলে নতুন করে লিখতে হবে কিন্তু।

বাসায় গেলাম। জব্বার গিয়েই গলা ছেড়ে ডাকল- ভাবি! চা খাব।

আমি খুঁজে বের করলাম গানটা। জব্বার গানটি খুব মনোযোগ দিয়ে দু-তিনবার পড়ল। বলল- এই না হলে কবি। কবি, তুমি দারুণ লিখেছ। চল, গানটিকে এবার ধার দিতে হবে।

সবুজের মা এত বলল- চা খেয়ে যান জব্বার ভাই।

আরেকদিন এসে খাব- বলেই আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে তার বাসায় তুলল জব্বার। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে বসলাম। উঠলাম সেই সন্ধ্যায়, সন্ধ্যা তখন ঘোর হয়ে গেছে। মাঝে একবার জব্বারের স্ত্রী কিছু খাবার দিয়ে গেছে।

এবার চল বাবার কাছে, মানে বঙ্গবন্ধুর কাছে। বাবা পাশ করে দিলে কালই রেডিওতে রেকর্ড করব। চললাম ৩২ নম্বরে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো রাত এগারোটায়। তিনি গানটি শুনলেন এবং বললেন- যা, কাল থেকে রেডিওতে এ গানটি বাজাতে শুরু কর।

গান তো হলো। বঙ্গবন্ধুর অনুমতিও পাওয়া গেল। কিন্তু গোল বাধালেন রেডিও কর্তৃপক্ষ, সংগীত বিভাগের প্রধান জনাব নাজমুল আলম। সবুজের মায়ের আপত্তির সেই লাইনটি- বাংলাদেশের লাখো বাঙালি/জয়ের নেশায় চলে রক্ত ঢালি। বাঙালিদের রক্ত ঢালার কথা বলা যাবে না। কেননা পাকিস্তান আর্মি-পুলিশ দুষ্কৃতকারীদের (?) শায়েস্তা করছে। কোনো দেশপ্রেমিককে তারা মারছেও না, ধরছেও না।

জব্বার তো রেগে টং। ধীর আলী ভাই (প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক) বললেন- চল, বড়ো জামান সাহেবের কাছে যাই। বড়ো জামান সাহেব মানে আশরাফ-উজ-জামান খান তখন ঢাকা বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক। তিনি জব্বারকে অতিরিক্ত স্নেহ করেন। তিনি সব শুনে বলে দিয়েছেন- গানটি এখনই রেডিও থেকে প্রচার হওয়া দরকার। শুধু একটি কথার জন্যে প্রচার হবে না, তা করা ঠিক হবে না। ফজল-এ-খোদাকে বল, আমি বলেছি- শুধু ‘রক্ত ঢালি’ পরিবর্তন করে দিতে। তিনি ‘রক্ত’ ‘ঢালি’ শব্দ দুটিতে গোল চিহ্ন দিয়ে গানটি নিজেই পাশ করে দিয়েছেন। শেষে বাক্যটিকে জয়ের নেশায় আনে ফুলেরও ডালি এভাবে লিখে দিলাম। গানটি ১৪ মার্চ ধীর আলী মিয়ার সংগীতায়োজনে রেকর্ড হলো এবং সেদিনই বেতার থেকে প্রচার করা হলো। ১৫ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতি অধিবেশনে একবার করে অর্থাৎ দিনে ২/৩ বার করে প্রচারিত হতে থাকল গানটি। আর প্রচারমাত্রই শহরে নগরে গ্রামে গঞ্জে বাঙালিদের কণ্ঠে কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়ল-

সালাম সালাম হাজার সালাম

     সকল শহিদ স্মরণে,

আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই

     তাদের স্মৃতির চরণে\

মায়ের ভাষায় কথা বলতে

স্বাধীন আশায় পথ চলাতে

হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ

সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান

     তাদের বিজয় মরণে\

ভায়ের বুকের রক্তে আজিকে

রক্ত মশাল জ্বলে  দিকে দিকে,

সংগ্রামী আজ মহাজনতা

কণ্ঠে তাদের নব বারতা

     শহিদ ভায়ের স্মরণে।

বাংলাদেশের লাখো বাঙালি

জয়ের নেশায় দিল রক্ত ঢালি

আলোর দেয়ালি ঘরে ঘরে জ্বালি

ঘুচিয়ে মনের আঁধার কালি

     শহিদ স্মৃতি বরণে\

দুই.

১৯৭১ সাল ২৫ মার্চ। মধ্যরাত ১২টা ১ মিনিট। পাকিস্তান আর্মি ট্যাংক-কামান-মেশিনগান-বন্দুক নিয়ে হিংস্র হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর ওপর। চারদিকে শিশুর চিৎকার, মায়ের আর্তনাদ, আক্রান্ত মানুষের প্রতিরোধ ধ্বনি জয় বাংলার আকাশ ফাটানো হুঙ্কার। একসময় রাত্রির অন্ধকার ভেঙে  ভোরের আলো দেখা দিল পূর্ব দিগন্ত জুড়ে। পাক হায়নার দল রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইক দিয়ে কারফিউয়ের ঘোষণা দিয়ে যেতে লাগল। এদিকে ঢাকাবাসী এক মুখ থেকে আরেক মুখে জেনে গেল পাকিস্তান আর্মির ক্রাক ডাউনের পরপরই বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঘোষণায় সকল বাঙালিকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের ঘাতকবাহিনীকে চিরতরে উৎখাত করার হুকুম দিয়েছেন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যার দিকে ঢাকার কারো কারো বেতারযন্ত্রে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর অনুষ্ঠান ধরা পড়ল। তাতে অনেকেই শুনতে পেল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী।

এদিকে কেউ কেউ পাকিস্তান আর্মির ম্যাসাকারে অর্থাৎ বাঙালি হত্যাযজ্ঞে ভীত হয়ে আবার কেউ কেউ রাতারাতি কেউকেটা হওয়ার আশায় পাকিস্তানের দালাল হয়ে গেল। বাঙালিদেরকে আরো কার্যকরভাবে শাসন করার জন্য পাকিস্তানের মিলিটারি জান্তা আর্মির ভেতর পাঞ্জাবিদের মধ্যে বাছাই করা কিছু সেনা সদস্য নিয়ে একটি বিশেষ সেল বা দল গঠন করেছিল যাদেরকে বাংলা শেখানো হতো; যাতে তারা বাঙালিদের কথা ও লেখা বুঝতে পারে। কিন্তু পাঞ্জাবিরা যতই বাংলাভাষা শিখুক তাদের পক্ষে বাংলাভাষার সূক্ষ্ণ কাব্য-কৌশল বোঝা সম্ভব হবে কী করে? অর্ধশিক্ষিত পাঞ্জাবিরা ভালো করে উর্দুই বোঝে না, সেখানে বাংলা বোঝার ব্যাপারটি রীতিমতো হাস্যকর। যেমন এখানে একটি উদাহরণ দেওয়া যায়- পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সম্মানে আয়োজিত ঢাকার রমনা গ্রিনে এক অনুষ্ঠানে বাঙালিদের প্রিয় শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার পরাক্রমশালী আইয়ুবের মুখোমুখি বসে গেয়েছিল- ‘তুমি কি দেখেছ কভু আইয়ুবের পরাজয়/দুখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়।’ আইয়ুব তো গানের মধ্যে তার নাম শুনে মহাখুশি। আইয়ুব ও তার পাঞ্জাবি সাঙ্গপাঙ্গরা এই ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে যে, বাঙালিরা আইয়ুবের নামেও গান বেঁধেছে। কিন্তু বাঙালি একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মুখ চুন হয়ে যাওয়ায় শোনা যায় আইয়ুব অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। যদিও সেই বাঙালি কর্মকর্তা পাকিস্তানের এক নম্বরের দালাল ছিল। আইযুব সন্তুষ্ট হয়ে মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের পিঠ চাপড়ে দিলেও ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষ প্রায় ছ’মাস বেতার থেকে জব্বারের গান গাওয়া বন্ধ রেখেছিল। সেই সময়ের আইয়ুবের প্রিয় ব্যক্তি এবং পাকিস্তান সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সচিব আলতাফ গওহর ঘটনা জানতে পেরে সংশ্লিষ্ট বেতার কর্মকর্তাকে এই কারণে কৈফিয়ত তলব করেছিলেন যে, কেন রেডিও পাকিস্তান থেকে জব্বারকে ব্ল্যাকলিস্ট করা হয়েছে? কৈফিয়তের উত্তর পেয়ে জনাব গওহর ওয়ার্নিংসহ জানিয়ে দিয়েছিলেন- পক্ষে হোক আর বিপক্ষে হোক গানের মধ্যে আইয়ুবের নাম ছিল এটুকুই যথেষ্ট নয় কি? প্রকৃত ঘটনা জানানোর জন্য দালালির পুরস্কার পাবে কি তা নয়, পেল রীতিমতো তিরস্কার এবং ধমক। ভারতীয় মোহাজের হাফ বাঙালি বেতার অফিসারটি শাঁখের করাতে যেমন হতবুদ্ধি তেমনি হতভম্ব। তাই ২৫ মার্চের পর বাঙালি এবং হাফ বাঙালিরা দ্বিধান্বিত কোন গান বাজাবে, কোন গান বাজাবে না সে-বিষয়ে। এই সময় কিছু অতি উৎসাহী বাঙালি টেপ থেকে সেইসব গান ও অনুষ্ঠান ইরেজ বা মুছে ফেলতে শুরু করল, যেগুলো ২৫ মার্চের আগে প্রচার করা হয়েছিল এবং বারবার বাজাবার জন্য টেপে বাণীবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। আবার সাবধানী এবং সাহসী বাঙালি বেতার-কর্মীরা সেই টেপগুলো সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিলেন।

বেতারের সেই সাহসী কর্মীদের মধ্যে আশফাকুর রহমান খান, টি এইচ শিকদার, তাহের সুলতান, শহীদুল ইসলাম, আশরাফুল আলম ও আজাহার উদ্দীনসহ আরো অনেকে ঠিক করলেন যেহেতু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুরু হয়ে গেছে, সেহেতু বিশেষ টেপগুলো সেখানে পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু টেপগুলো বেতারভবনের বাইরে বের করে নিয়ে যাবার উপায় কী? গিটারিস্ট হাফিজুর রহমান বললেন- আমি তো প্রতিদিনই কাপড়ের কভারে ভরে আমার গিটার বেতারভবনের ভেতরে নিয়ে আসি এবং বাইরে নিয়ে যাই। স্পুল থেকে টেপ খুলে গিটারের খোলে ভরে আমি অনায়াসেই বাইরে নিয়ে যেতে পারি। ইউরেকা! উপায় পাওয়া গেছে। সেভাবেই প্রায় একমাস ধরে শাহবাগের বেতারভবন থেকে প্রায় সব প্রয়োজনীয় টেপ বাইরে পাচার হয়ে গেল। এবং সেই টেপ বালিশের তুলো হয়ে আগরতলা দিয়ে মুজিবনগরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছুল।

‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানও পৌঁছে গেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৪ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সালাম সালাম গানটি বেতার থেকে বারবার প্রচারিত হওয়ায় এরই মধ্যে সংগ্রামী বাঙালিদের উদ্দীপনা সংগীত হয়ে গেছে। আর এই সময় আমি ও জব্বার যতবার বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হয়েছি ততবারই তিনি হয় ‘সালাম সালাম’ না হয় ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গেয়ে উঠেছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে জব্বারও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সুর ধরেছে। সে এক অপূর্ব পরিবেশ। ঐ সময়ে একদিন বঙ্গবন্ধু বললেন- জব্বার, গানটির দারুণ সুর করেছিস; গাইতে গেলে প্রাণটা ভরে যায়। আর (আমাকে দেখিয়ে) কবি গানটি লিখেছেও চমৎকার।

মার্চে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনকে বিষয়বস্তু করে আরো একটি গান আমি লিখেছিলাম টেলিভিশনের জন্য। গানটির প্রচার সম্পর্কে জাহানারা ইমাম তাঁর একাত্তরের দিনগুলি বইতে ১৮ মার্চ বৃহস্পতিবার ১৯৭১-এ লিখেছেন:

‘ঢাকা টেলিভিশন স্বাধিকার আন্দোলনকে তুঙ্গে তুলে দিয়েছে তার অভিনব গানের অনুষ্ঠান দিয়ে। এমন অনুষ্ঠান দেখি নাই কভু। ঢাকার যত প্রথম সারির নামকরা সংগীত শিল্পী ফেরদৌসী রহমান, সাবিনা ইয়াসমীন, শাহনাজ বেগম, আঞ্জুমান আরা বেগম, সৈয়দ আবদুল হাদী, খোন্দকার ফারুক আহমদ, রথীন্দ্রনাথ রায় এবং আরো অনেকে মিলে যখন গাইতে থাকেন ‘সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম। চলবেই দিনরাত অবিরাম’ আর তাঁদের কয়েকটা চেহারা হাজার চেহারা হয়ে যায়; তখন মনে হয় বুকের মধ্যে, ঘরের মধ্যে ঝড় উঠে গেছে, সে ঝড়ের মাতামাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

মাসুমাকে জিজ্ঞেস করি, ‘কী করে এমন অবাক কাণ্ড সম্ভব হলো? কে করেছে?’

মাসুমা বলে, ‘এসব মন্টুমামার কীর্তি।’

মন্টু, অর্থাৎ মুস্তাফা মনোয়ারকে ধরলাম একদিন, ‘মন্টু বলো না, কী কায়দায় শিল্পীদের একেকটা মাথা হাজার মাথা হয়ে যায়? দু-তিন সার দাঁড়ানো মানুষ হাজার মানুষ হয়ে যায়?’

মুস্তাফা মনোয়ার তার স্বভাবসিদ্ধ বিনীত লাজুক হাসি হেসে মাথা চুলকে বলল, ‘এই আর কী। যন্ত্রপাতি বিশেষ নেই তো আমাদের। এই আয়না-টায়না দিয়ে, অনেক কসরত করে এই করা আর, কী।’

মন্টুটা এই রকমই। নিজের কোনো কৃতিত্বের কথা নিজের মুখে বলতে হলে এই রকমই তো-তো করে!’

আবার ১৯ মার্চ  টেলিভিশনে আমি স্বরচিত কবিতা পাঠের একটি আসর পরিচালনা করি। ঐ আসরে আমি ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি কবিতা পড়ি। এই কবিতার আসরটি প্রযোজনা করেন প্রখ্যাত নাট্যকার ও টেলিভিশন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন। ২৫ মার্চের পরপরই পাকিস্তান আর্মি টেলিভিশন থেকে আমার গান ও কবিতার ভিডিও টেপ দুটি সিজ (আটক) করে। রেডিওতে সালাম সালাম গানের টেপ সিজ করতে এসে খুঁজে না পেয়ে আমাকে কৈফিয়ত তলব করা হয়- ‘কেন আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না?’ এবং এই বিষয়টি আমাকে অবহিত করেন বিশিষ্ট বেতার ব্যক্তিত্ব ও একজন সহৃদয় গুণী সহকর্মী আহমেদুজ্জামান। সম্ভবত দিনটি ছিল একাত্তরের এপ্রিল মাসের ২ বা ৩ তারিখ। তিনি বেতারভবনের গেট দিয়ে বেরোচ্ছেন আর আমি ঢুকছি। জামানভাইকে দেখে আমি সালাম দিতেই তিনি আমার সালামের উত্তর না দিয়ে আমাকে ফিরিয়ে গেট দিয়ে বের হতে হতে বললেন- অনেক সালাম দিয়েছেন, আর সালাম দেবার দরকার নেই। এখন আসুন আমার সঙ্গে। এবং আমার নামে যে অফিস থেকে চিঠি ইস্যু হচ্ছে সে কথা বললেন। তিনি সাধারণত কম কথা বলেন। শুধু আর একটি কথা বললেন- আপাতত আর এ মুখো হবেন না, পারলে বাসায়ও থাকবেন না। ঢাকা থেকে চলে যাওয়াই ভালো। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে জানতে পারি আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

মে-জুন মাসের দিকে জানতে পারলাম, আমার নামে নাকি পুলিশি হুলিয়া জারি হয়েছে। তাতে গ্রামের বাড়িতে থাকাও নিরাপদ নয়। অবশ্য ততদিনে আমি যুদ্ধক্ষেত্রে। আরো জানা গেল, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গান গাওয়ার জন্য পাকিস্তান আর্মি অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেছে মোহাম্মদ আবদুল জব্বারকে ধরিয়ে দিতে, জীবিত কিংবা মৃত। এবং জব্বারের অনুপস্থিতিতে তার রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য তাকে ১৪ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে। আর গিটারিস্ট হাফিজুর রহমানকে বেতারভবন থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে টেপ পাচারের অভিযোগে। হাফিজভাই আর ফিরে আসেননি। তিনি শহিদ হয়েছেন।

যুদ্ধ শেষ হলে এবং জব্বার মুজিবনগর থেকে ফিরে এলে বঙ্গবন্ধু তাকে সালাম সালাম গান সুর করা ও গাওয়ার জন্য স্বর্ণপদক দেওয়ার ঘোষণা দেন। মুজিবনগরেই সালাম সালাম গানের ডিস্ক রেকর্ড বের করে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি। ডিস্ক বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় বিশ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায় বলে রেকর্ড কোম্পানি দাবি করে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত গীতিকবি শ্রী গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার গানটি শুনে গানের রচয়িতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার ও রথীন্দ্রনাথ রায়ের কাছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীমেলা উপলক্ষ্যে কলকাতায় আমার সঙ্গে গৌরীদার দেখা হয়। তিনি বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব আলোকচিত্রশিল্পী লুৎফর রহমানের উপস্থিতিতে আমার প্রশংসা করে বলেন- ‘ফজলে, তোমার এই একটি রচনাই তোমাকে অমর করে রাখবে।’ লুৎফরের ধারণা এর চেয়ে বড়ো মূল্যায়ন আমার আর হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের পরে লন্ডন থেকে গটঝওঈ ঙঋ ইঅঘএখঅউঊঝঐ শিরোনামে একটি এলপি রেকর্ড প্রকাশিত হয়, যার এগারোটি গানের একটি ‘সালাম সালাম’।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর বাংলাদেশ বেতার কোনো ঘোষণা ছাড়াই খুনিদের ইচ্ছায় রেডিও পাকিস্তানের ধাঁচে রেডিও বাংলাদেশ হয়ে গেল। মেজররাই তখন বেতারের সর্বময় কর্তা। মাথার ওপর বিনা মেঘে বজ্রপাত হলে যে অবস্থা হয়, ঠিক সেই রকম একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির শিকার হলাম আমরা। তখন আমরা শুধুই রুটিন ওয়ার্ক করে যাচ্ছিলাম। বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের কাজ হলো জাতীয় পর্যায়ের জরুরি বিষয়গুলো সংরক্ষণ করা। রুটিন ওয়ার্ক মানে দৈনন্দিন কাজ হিসেবেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংরক্ষণের জন্য স্টুডিয়োতে টেপ ট্রান্সফার করা হচ্ছিল। ট্রান্সফারের কাজ করছিলেন নির্মলচন্দ্র মন্ডল। হঠাৎ খুনিরা স্টুডিয়োতে ঢুকে পড়ল এবং দেখল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজানো হচ্ছে। আর যায় কোথায়? গরুর মতো পেটাতে শুরু করল সবাইকে। পিটিয়ে ধরে নিয়ে গেল আশরাফুল আলম ও নির্মলচন্দ্র মন্ডলকে। শুনতে পেয়ে ছুটে গেলাম ট্রান্সক্রিপশনে। ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের পরিচালক শহীদুল ইসলাম তখন দপ্তরে ছিল না। আশরাফের অপরাধ, সে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এক টেপ থেকে আরেক টেপে ট্রান্সফারের নির্দেশ দিয়েছে। কে বা কারা বলেছে আশরাফুল আলম বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো বাইরে পাচার করে নিয়ে যাবার জন্য এই ট্রান্সফার করাচ্ছে। শহীদ আর আমি তখন বেতারের দায়িত্বে নিয়োজিত সামরিক কর্মকর্তা ও তাদের সংশ্লিষ্টজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকলাম যাতে তাদের ছাড়িয়ে আনা যায়। আশরাফ শুধু সহকর্মী নয়, সে আমাদের দুজনেরই ব্যক্তিগত বন্ধু। আমি তখন বাংলাদেশ বেতারের প্রকাশনা দপ্তরের সম্পাদক।

৩ অক্টোবর। রোজার মাস। মা আমার বাসায়। রাত তিনটা বাজে। আর কিছুক্ষণ পরেই সবাই সেহরি খেতে উঠবে। এমন সময় আমার নাম ধরে ডাক। আগারগাঁও সরকারি বাসার সামনে চার-পাঁচটি মিলিটারির গাড়ি। শহীদুল ইসলামকে তার মতিঝিলের বাসা থেকে তুলে এনেছে মেজর শাহরিয়ার ও তার দল। আমাকেও ওরা নিতে এসেছে। মা ও আমার স্ত্রী তো কেঁদেকেটে একশা। শাহরিয়ার সান্ত্বনা দিয়ে বলল- রেডিওর জরুরি একটা কাজে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বাসায় ফিরে আসতে পারব। আমি কিন্তু ভয় পেয়ে গেছি। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তারা নিয়ে যাওয়ার মানেই নির্ঘাৎ মৃত্যু। শুধু ভাবলাম আমার মৃত্যুর খবর যখন এ বাসায় আসবে তখন আরো দুটো লাশ যুক্ত হবে- একটি মায়ের আর একটি আমার স্ত্রীর। ওরা কিছুতেই আমার মৃত্যু সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু আমার কচি কচি তিনটি ছেলেকে কে দেখবে? ওরা যে আমার মতোই এতিম হয়ে যাবে। আমি যেমন খুব ছোটোবেলায় আমার বাবাকে হারিয়েছিলাম। আমার তো মা ছিল। ওদের তো মা-ও থাকবে না। ওরা কি তবে পথের ছেলে হয়ে যাবে? শুধু মা, ছেলে ও তাদের মায়ের মুখটাই আমার বারবার মনে পড়ছিল।

আমাদেরকে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। পরের দিন রাত পর্যন্ত আমাকে ও শহীদুল ইসলামকে রাখা হলো একই ঘরে। কোন অপরাধে আমাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, মেজরের কাছে জানতে চাইলে তার এক কথা, পরে জানানো হবে। অনেক অনুনয়-বিনয় করে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরের কাছে জানতে পারলাম- আমরা নাকি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মতো ‘বঙ্গবন্ধু বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। আমরা শুনে তো হাঁ। আমাদের দুজনের কারো মুখেই কোনো কথা নেই। এমন ডাহা মিথ্যা গুজব রটাল কে? তবে আমরা দুজনই এই ভেবে সান্ত্বনা পেলাম- যা হোক বঙ্গবন্ধুর জন্য আমরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছি। সে রাতেই আমাদের দুজনকে আলাদা করে ফেলা হলো। এবং চলল ইন্টারোগেশন- প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন। ওদের কে একজন বলল, মেজর…অমুক বলেছেন, এই ফজল-এ-খোদা হলো সালাম সালাম হাজার সালাম গানের লেখক এবং ২ নম্বর সেক্টরের মেজর হায়দারের একজন সহযোদ্ধা। ৫/৭ জনের মধ্যে আরেকজন বলল, আগে বলনি কেন? হুজ দ্যাট ব্লাডিফুল, যে তোমাদেরকে এসব ইননোসেন্টদের বিরুদ্ধে বাজে সব ইনফরমেশন দিচ্ছে। আমাকে তারপরই আরেকজন জিজ্ঞেস করল- আপনি সালাম সালাম গানটি লিখেছেন? আমি শুধু বললাম- জি। আমি ছাড়া পেলাম। শহীদও ছাড়া পেল।

যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তাদের হাত থেকে রেহাই পেলাম এই সালাম সালাম গানের জন্যেই। প্রাণে বেঁচে যাওয়ার চেয়ে এই গানের জন্য আর কী বড়ো প্রাপ্য চাই আমার?

এখানে প্রসঙ্গত একজনের কথা না বললেই নয়। সে হলো বাংলাদেশ বেতারের স্টাফ অ্যানাউনসার রোকেয়া আব্বাস। সে বেতারের ছোটো-বড়ো সকল কর্মী ও কর্মকর্তাদের রোকেয়া আপু। সবার সঙ্গেই তার তুমি আমি সম্পর্ক। রোকেয়া আপু বেলা বারোটা-সাড়ে বারোটার দিকে টিফিন কেরিয়ার ভর্তি খাবার নিয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে এসে উপস্থিত। সঙ্গে একজন পুলিশ কর্মকর্তা। আপু পাহারারত পুলিশকে বলল, যাও দুটি থালা, দুটি গ্লাসে আর জগে পানি নিয়ে এসো। থালা আসতেই আপু আমাদের বলল- নাও, ঝটপট খেয়ে নাও। আমাকে একবার ক্যান্টনমেন্টে যেতে হবে।

রোকেয়া আপুর স্বমী ছিলেন বিমানবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সেই সুবাদে ক্যান্টনমেন্টে তার অবাধ যাতায়াত। পরে জানতে পেরেছি, আমাদের মুক্তির জন্য সে সামরিকবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছে। বলেছে, ওরা খুবই গুণী ছেলে। ওদের দ্বারা যদি তোমাদের কোনো ক্ষতি হয় সেজন্য আমি দায়ী থাকব। ওদের তোমরা ছেড়ে দাও। ওদের সম্পর্কে তোমরা যা শুনছে সব মিথ্যে, সব বানোয়াট।

রোকেয়া আপুর এই ভূমিকার কথা কি ভোলা যায়?

লেখক পরিচিতি: কবি, গীতিকার, শিশু সাহিত্যিক,   সংগঠক এবং বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *